Skip to main content

অপারেশন পোলো

 কম্যুনিস্টরাও একদিন হিন্দু মহাসভার সঙ্গে একসঙ্গে মূষলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছিল.....!! 


# অপারেশন পোলো ১


যখন ভারত বিভাজনের সময় হল, তখন যুগপৎ ব্রিটিশ ও ভারতীয় নেতারা দেখলেন, ভারতের জন্য যে ছটা দেশীয় রাজ্য ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তা হল জম্মু-কাশ্মীর, জুনাগড়, ত্রাভাঙ্কোর, ভোপাল, যোধপুর এবং হায়দ্রাবাদ৷ প্রথম সমস্যা ভারত সরকার অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু আসল সমস্যা ছিল দুই মুসলিম শাসক, কিন্তু হিন্দু প্রধান রাজ্য — জুনাগড় ও হায়দ্রাবাদকে নিয়ে। ভোপাল ও যোধপুর কিন্তু এক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করেনি, যদিও ভোপালের শাসক একজন মুসলিম ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, চাইলেও ভোপালকে পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কিছু দর কষাকষির শেষে ভারতভুক্ত হতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু প্রথমে জুনাগড় ও পরে হিন্দু প্রধান রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরকে ভারতভুক্ত করতে বিশেষ রকমের বেগ পেতে হয়েছিল নেহেরু অ্যান্ড কোম্পানিকে। এমনিতে অহিংসা পরম ধর্মকে আদর্শ হিসাবে মানলেও নেহেরু কিন্তু ভারতকে একত্রিত করার ব্যাপারে অন্তত নির্মম মনোভাব নিয়েছিলেন। তিনি ‘অবাধ্য মহারাজাগণকে’ উচিত শিক্ষা দিতে কাজে লাগিয়েছিলেন ক্যাবিনেটের সবচেয়ে কঠোর ব্যক্তিকে — সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে। এছাড়া ভিপি মেনন তো ছিলেনই। ভিপি মেনন ছিলেন সমঝোতার টেবিলে বসতে বলা হয়, অন্যদিকে প্যাটেলকে ‘সামরিক’ দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছিল। 


***************** 


ভারতকে একত্রিত করার কাজ মোটেও সহজ ছিল না। ১৯৪৭-৪৮ সালের মধ্যে ভারতে ৬০০ দেশীয় রাজ্য ছিল। অধিকাংশ আকারে ছোট হওয়ায় ভয় দেখিয়ে তাদের ভারতভুক্তির কাজ প্যাটেল ও মেননের পক্ষে বেশ সোজা কাজ ছিল। যেটা জম্মু-কাশ্মীর ও হায়দ্রাবাদ সম্বন্ধে বলা যায় না। দুই রাজ্যের আকার যেমন বিশাল ছিল, তেমনই রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বাকি দেশীয় রাজ্যের তুলনায় ভিন্ন ছিল। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শাসক মহারাজ হরি সিংহ ছিলেন ডোগরা হিন্দু, কিন্তু সংখ্যাগুরু প্রজা ছিলেন মুসলিম। অন্যদিকে হায়দ্রাবাদে সংখ্যাগুরু প্রজা হিন্দু হলেও শাসক ছিলেন মুসলিম নিজাম। ব্রিটিশ দ্বারা সৃষ্ট দক্ষিণ ভারতের প্রাচীনতম দেশীয় রাজ্য হিসাবে পরিচিত হায়দ্রাবাদ ১৭২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২৫ বছর ধরে আসফ শাহী রাজবংশের অধীনে ছিল। হায়দ্রাবাদের দু দুটো বড় আকারের প্রেসিডেন্সির মাঝখানে স্যান্ডুইচ হয়ে ছিল — মাদ্রাজ ও বোম্বাই। সেই মুঘল যুগ থেকেই রাজধানী হায়দ্রাবাদের সংখ্যাগুরু প্রজা ছিলেন মুসলিম এবং তারা নিজামকে (মহান শাসক) শাসন করার সব রকম সুযোগ দিতেন। এই মুসলিমদেরই স্থানীয় হিন্দুরা একটি গালি দিয়ে পরিচয় দেন : রাজাকার। অকারণে মুসলিমরা এই নাম কেনেনি। প্রথমে মুঘল সেনাবাহিনী, পরে মারাঠা, তারপর যথাক্রমে ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে নিজামের সঙ্ঘাত লেগেছিল দক্ষিণের ‘চাবিকাঠি’ হায়দ্রাবাদ দখল করা নিয়ে। কিন্তু হায়দ্রাবাদের ‘রাজাকার’ বাহিনী প্রতিবারই সে সংকট থেকে উদ্ধার করেছে গেরিলা লড়াই দিয়ে। শেষপর্যন্ত ১৮১০ দশকে নিজাম ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা করে নেন বার্ষিক নজরানা প্রদানের বিনিময়ে। ব্রিটিশরা এরকম একটা ‘কামধেনু’ পেয়ে নিজামকে আর ঘাঁটান নি। এরপর প্রায় দেড়শ বছর ধরে নিজাম নিশ্চিন্তে হিন্দু প্রজাদের রক্ত চুষে নিয়ে শাসন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 


উনবিংশ শতকের শেষদিকে হায়দ্রাবাদের নিজাম হয়ে ওঠে বিশ্বের ধনীতম শাসকের একজন। উদাহরণ হিসাবে অন্তিম নিজাম স্যার মীর ওসমান আলি খান সিদ্দিকির কথা বলা যায়। উনিশশো ত্রিশ থেকে চল্লিশ দশকের মধ্যে তাকে ফোর্বস ম্যাগাজিন ‘বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি’র তকমা দিয়েছিল। তিনি নিজেই একবার বলে ফেলেছিলেন, “আমার হাতে যা পরিমাণ অর্থ আছে, তা দিয়ে রোমানিয়ার মত ছোট দেশকে কিনে ফেলতে পারি!” বলা বাহুল্য, তার দাবি মোটেও অবাস্তব ছিল না। ব্রিটিশরা ভেবে অবাক হত যে, নিজাম কিভাবে এত বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও কঠিন কাজ নয়। প্রথমত, তিনি হিন্দুদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের জিজিয়া কর আদায় করতেন। যার পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। দ্বিতীয়ত, তার রাজ্যে অসংখ্য চিনি ও কাপড়ের মিল ছিল, সেখান থেকেও আয় মন্দ হত না। দুই জায়গাতেই শ্রমিক ছিল হিন্দুরা ও মিলের দেখভালের দায়িত্বে ছিল মুসলিমরা। নিজাম নিজের সেনাবাহিনীর ওপর খুব বেশি ভরসা করতে না পেরে অন্তত তিনটে লেঠেল বাহিনী বানিয়েছিলেন, সেখানে কাজ করত আরব, পাঠান ও তুর্কী। নিজাম নিজেও তুর্কী ছিলেন বলে, তিন লেঠেল বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল তুর্কী বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা। এছাড়া হিন্দু জনসংখ্যা কমাবার উদ্দেশ্যে নিরাজাাম বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও জিহাদের আশ্রয়ও নিতেন বৈকি। এই কারণে প্রতি বছর হায়দ্রাবাদ রাজ্যে অন্তত ৫-৬ বড় মাপের দাঙ্গা হত। এইসব কারণে উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে নিজামের বিরুদ্ধে জনমানসে অসন্তোষ জন্মায় এবং বেশ কয়েকটি নিজাম বিরোধী আন্দোলন হলেও, তা বেশিদিন টেকেনি। কারণ অবশ্যই ব্রিটিশদের সহযোগিতা ও নিজামের নিজস্ব লেঠেল বাহিনী। জুনাগড়ের শাসক কিন্তু জিজিয়া কর আদায় বা বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা — কোনটাই তার সুদীর্ঘকাল রাজত্বে করান নি। এরকারণ সম্ভবত তার ১০০% ভারতীয় রক্ত কাজ করছে। অন্যদিকে নিজাম ছিলেন বিদেশী বংশোদ্ভূত, আসফ শাহী রাজবংশের কেউই ভারতীয় মহিলাকে বিবাহ করেন নি। প্রত্যেক বিবি এসেছিল তুরস্ক থেকে। 


হায়দ্রাবাদের ওপর নিজামের আধিপত্য বজায় রাখতে যার ভূমিকা সর্বাধিক ছিল, তার নাম কাশিম রিজভি, জাতিতে তুর্কী কাশিম রিজভি পেশায় ছিলেন চারমিনার মসজিদের ইমাম। তার অনুগামীরা রাজাকার নামে কুখ্যাত ছিল। কাশিম রিজভি একটা রাজনৈতিক দলও খুলেছিল, নাম ছিল ‘ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’, এই দলটা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও বাস্তবে একটি মৌলবাদী সংগঠনের বাইরে কিছু ছিল না। স্বাধীনতার পর ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের নাম পালটে হয়েছে ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ঈত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (AIMIM), যার নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। 


রিজভির রাজাকার বাহিনী ১৯৪৬ সালের পর থেকে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে হিন্দুদের ভীত, সন্ত্রস্ত করে রেখে পাকিস্তানভুক্তির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে রিজভির এই কাজটা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছিল তারই একান্ত প্রিয় ‘মালিক’ নিজামের দিকে। রাজাকারের দৌরাত্ম্যে বিরক্ত হয়ে ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে উচিত শিক্ষা দিতে হায়দ্রাবাদে সেনা পাঠাবার কথা ভেবেছিল। 


অন্ধ্র হিন্দু মহাসভা নামে একটি রাজনৈতিক দল সবার কাছে নিজাম ও রাজাকারদের এই কুকীর্তির কথা সবার কাছে ফাঁস করে দেয়। অন্ধ্র হিন্দু মহাসভার দাবি ছিল যে, রাজাকাররা হিন্দুদের ‘জাতিগত সাফাই’ (Ethnic Cleansing) করার চেষ্টা চালাচ্ছে শান্তি বজায় রাখার নামে, যা নিজামের মদত ছাড়া সম্ভব ছিল না। হায়দ্রাবাদের হিন্দু জনসমষ্টিকে বাঁচাতে হলে কংগ্রেসের উচিত হবে সেখানে সেনা পাঠানো। অন্ধ্র হিন্দু মহাসভার এই দাবিতে সাড়া ভারত জুড়ে চাঞ্চল্য শুরু হয় এবং তাতে কংগ্রেস দলের নেতারাও বিব্রত হন। এই ইস্যুতে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে তারা জনসমর্থন হারাবার আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করে। অন্যদিকে ব্রিটিশরা ভারত সরকারকে হায়দ্রাবাদের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য পরামর্শ দেবার নামে প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’ দিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে বলেছিলেন, হায়দ্রাবাদের অবস্থা যেন আরেকটা জম্মু-কাশ্মীর না বানিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলে ভারত একঘরে হয়ে যাবে। নেহেরু বুঝেছিলেন হায়দ্রাবাদ সঙ্কট জিইয়ে রাখার ব্যাপারে গ্রেট ব্রিটেনের আগ্রহ আছে, তারা এইভাবে পরোক্ষ ভাবে ভারতের রাজনীতিতে নাক গলাতে চায়। নেহেরু তখন কড়া ভাবেই মাউন্টব্যাটেনকে বলেন, “আমরা কি করব, সেটা আমাদের বুঝতে দিন। এটলিকে বলবেন, ভারত এই মুহূর্তে ব্রিটেনের অধীনে নেই।” মাউন্টব্যাটেন এতে বিস্মিত হন এবং বোঝেন তাদের দ্বিচারিতা ভারত আর মানতে রাজি হবে না। ঐ সময়ে হায়দ্রাবাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩% মুসলিম হলেও সে রাজ্যের ৯২% জমি ও ৯৬% সরকারি চাকরি তাদের পকেটস্থ ছিল। যা হিন্দুদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছিল। তারা ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে নিজাম বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়ে। 


ভারত শুরুতে হায়দ্রাবাদ সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ ভাবে মেটাতে চেয়েছিল। তারা প্রস্তাব দিয়েছিল জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের ন্যায় হায়দ্রাবাদকে "ষ্টেট উইদিন ষ্টেট" মর্যাদা দেওয়া হবে এবং আগের মতই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মুসলিমরাই জায়গা পাবেন। কিন্তু নিজাম এই প্রস্তাবকে দুর্বলতা ভেবে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলেন, “আমরা বিশ্বাসীদের (মুসলমানদের) জন্নত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই। আমি অবিশ্বাসীদের (কাফের/হিন্দুদের) অধীনে থাকতে রাজি নই।” এই ঘটনায় প্যাটেল অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হন। তিনি নেহেরুকে প্রস্তাব দেন যদি তাকে হায়দ্রাবাদকে গায়ের জোরে ভারতভুক্ত করতে না দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। মোটামুটি একই সময়ে মেনন অবধি জানান, তিনিও একই পথ নেবেন যদি না সামরিক উপায়ে হায়দ্রাবাদ সঙ্কট মেটানো হয়। কেননা ‘এই মুহূর্তে নিজামের নির্দেশে তার রাজাকার বাহিনী অবিশ্বাসীদের সাফাই করার জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছে।’ নেহেরু এতে চাপে পড়ে যান। 


১৯৪৮ সালের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্ধ্র হিন্দু মহাসভা রাজাকারদের বিরুদ্ধে পালটা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করলে হায়দ্রাবাদের পরিস্থিতির অবনতি হয় এবং তা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিবিসির মত কট্টর ভারত বিরোধী সংবাদ সংস্থাও অবধি স্বীকার করেছিল যে, নিজামের রাজাকার বাহিনী নাজি বাহিনীকেও ছাপিয়ে গেছে নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে। তারা খোলাখুলিই বলেছিল ‘নিজাম মুসোলিনির চেয়েও ক্রূর অত্যাচারী।’ বিবিসি এও জানিয়েছিল যে, রিজ়ভির রাজাকার বাহিনীর বর্বরতা সভ্যতার কলঙ্ক বিশেষ। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় ‘নৌপথে নিজাম নাকি পাকিস্তান থেকে সামরিক উপকরণ, অস্ত্র আমদানি করছেন। তিনি নাকি জানিয়েছেন হায়দ্রাবাদকে পাকিস্তানের ন্যায় একটি স্বাধীন, সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে চান।’ নিউ ইয়র্ক টাইমস দাবি করেছিল, ‘রাজাকাররা যা করছে, তাতে হায়দ্রাবাদে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ স্রেফ সময়ের অপেক্ষায় আছে।’ বলা বাহুল্য, এইসব রিপোর্টিং নেহেরুকে অস্বস্তিকে রেখেছিল। কিন্তু তিনি নিজের সঙ্কল্প থেকে দূরে সরেন নি।



India's Wars: A Military History, 1947-1971 by Arjun Subramaniam


কলমে: শ্রী অয়ন চক্রবর্তী।।

———————————————————

ভারতের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা, যেখানে ঠেলায় পড়ে কম্যুনিস্টরাও মূষলমানদের সঙ্গে লড়াই করেছিল....। তাও আবার হিন্দু মহাসভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে!! 


# অপারেশন_পোলো ২ 


এরপর নেহেরু ভাবতে লাগলেন কিভাবে হায়দ্রাবাদকে ভারতভুক্তির আওতায় ফেলা যায়। এখানে বলে রাখি যে, নিজামকে বাধ্য করে হায়দ্রাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনাকে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হায়দ্রাবাদ পুলিস অ্যাকশন।’ এমন নামকরণের পেছনে কি কি কারণ ছিল সেটা কিছুক্ষণ বাদে জানা যাবে। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক মহলে একঘরে হওয়া আটকাতেই প্যাটেল এমন নামকরণ করেছিলেন; যাতে পুরো ঘটনাকে ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে দেখানো যায়। যেটা ‘অপারেশন বিক্রম’ মার্কা নাম দিলে হত না। প্যাটেল চেয়েছিলেন সারা বিশ্ব (যার মধ্যে গ্রেট ব্রিটেনও ছিল) যেন একে নিছক পুলিস দ্বারা দুষ্টের দমন গোছের ব্যাপার করে দেখুক। বাস্তবে এটা অন্য কিছু ছিল তা নেহেরুর মাদ্রাজে দেওয়া ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালের ভাষণ থেকেই পরিষ্কার, যেখানে তিনি বলেন, “আপনারা (শ্রোতা) জেনে রাখুন, আমরা হায়দ্রাবাদ দখল করে নেব। আর সেটা সামরিক উপায়ে। যখন হবে, দেখতে পাবেন।” তখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নেহেরু মোটামুটি মনস্থির করে ফেলেছেন ভারতের বৃহত্তম দেশীয় রাজ্যকে কিছুতেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বা সার্বভৌম হতে দেবেন না। 


ব্রিটিশ আমল থেকেই হায়দ্রাবাদের যমজ শহর হিসাবে পরিচিত সেকেন্দ্রাবাদ ছিল দাক্ষিণাত্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বৃহত্তম ঘাঁটি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে হায়দ্রাবাদে মোতায়েন ছিলেন সবচেয়ে প্রবীণ সেনা আধিকারিক মেজর জেনারেল সি.ই. পার্ট। তিনি চিঠি লিখে দিল্লিতে থাকা আরেক ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক জেনারেল বুচারকে লেখেন, “হায়দ্রাবাদের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। আমি খুবই চিন্তিত বোধ করছি ঘাঁটির সুরক্ষার কথা ভেবে। রাজাকাররা যেকোনো সময়ে ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে আমাদের মেরে অস্ত্রগুলো লোপাট করে সেগুলো যুদ্ধে লাগাতে পারে। কিভাবে এই সমস্যা থেকে বাঁচব জানি না।” তিনি এটা লিখে থামেন নি, নিজের ভারতীয় সহযোগীদের এমন সম্ভাবনা তৈরি হলে কি করতে হবে; তাও বলে দেন। পার্ট জানতেন যে, এখানে যেসব সেনা মোতায়েন আছে, তাদের পক্ষে রাজাকারদের রুখে দেওয়া শুধু অসম্ভব নয়, হাস্যকরও বটে। যদিও পার্টের আরেকজন ব্রিটিশ সহযোগী তাকে ‘শত্রুদের বড্ড বেশি তোল্লাই দিচ্ছেন, তার মূল্যায়ন সঠিক নয়।’ অবধি বলেন। 


এদিকে ব্রিটিশ সাউদার্ন কম্যান্ড এর প্রধান হিসাবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল গডার্ড বরাবরই স্পষ্টবাদিতার জন্য ব্রিটিশ ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু তিনিও পার্টের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারেন নি। বরং তিনি আরও স্পষ্ট ভাবে বলেন, “রাজাকাররা সত্যিই হায়দ্রাবাদের সর্বত্র তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের ক্রূরতা, নিষ্ঠুরতা সব সীমা অতিক্রম করেছে। ইত্তেহাদুল মুসলিমিন মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে তাদের কীর্তিকলাপ নাজিদেরও হার মানিয়েছে। হায়দ্রাবাদের হিন্দু সম্প্রদায়কে সাফ করতে যা যা করা উচিত সবই করছে। এদের থামাতে হলে সব রকম রাজনৈতিক মতভেদতা বন্ধ রেখে এখুনি সামরিক অভিযান চালানো দরকার। নাহলে পরিস্থিতি আর সামাল দেওয়া যাবে না। সেখানে কমিউনিস্ট আর মহাসভা রাজাকারদের পাল্টা দিয়ে অবস্থাকে আরও জটিল করে দিচ্ছে।”


ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে গডার্ডের এই ভাষণের পর ভারত সরকার মোটামুটি পরিকল্পনা করে ফেলে হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযান চালাবে। তারপরেও সবকিছু গুছিয়ে নিতে সেপ্টেম্বর গড়িয়ে গেল। যদিও জুলাই মাস থেকেই হায়দ্রাবাদের দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তে রাজাকার বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর (জানুয়ারি ১৯৪৯ সালের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষের কোনও পদে ভারতীয় ছিল না) বেশ কয়েকবার খণ্ডযুদ্ধ লেগেছিল। এরপর বিজাপুরের দিকে রাজাকাররা একজন সেনাবাহিনীর আরমার্ড স্কোয়াড্রনের একজন ব্রিটিশ সদস্যকে হত্যা করলে পরিস্থিতি আরও বেহাল হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকারও বুঝতে পারে, নিজাম হায়দ্রাবাদের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন, তার বদলে কাশিম রিজভি এই মুহূর্তে হায়দ্রাবাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এরপরেই ভারত সরকার নিশ্চিত হয়ে ফেলে তারা হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযান চালাবে। যদিও তারা মুখে একে সামান্য পুলিস অ্যাটাক বলে চালাচ্ছিল। বম্বে ক্রনিকল নামে একটি সংবাদপত্রে ১৭ আগস্ট ১৯৪৮ সালে প্রতিবেদন করে কিভাবে রাজাকাররা আজকের মহারাষ্ট্রের নান্দেদ ও বেরার জেলায় গণহত্যা ও লুণ্ঠন পর্ব চালাচ্ছে। এমনকি ব্রিটিশরাও তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ঐ দিনেই বিলোলি নামক স্থানে কাশিম রিজভি ধর্মযুদ্ধের ডাক দেন। তিনি বলেন, “আমরা কোনও অবস্থাতেই যুগ যুগ ধরে হায়দ্রাবাদ যে সার্বভৌমত্বের স্বাদ পেয়ে এসেছে, তা হারাতে দেব না। যত সমস্যাই হোক না কেন, আমরা ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে যাব প্রত্যেকটা অবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে, সে ভারতীয় হোক বা ব্রিটিশ। তারা হায়দ্রাবাদের ভেতরে ঢুকলে জীবন্ত যাতে ফিরতে না পারে, তার ব্যবস্থা করব। আজ হায়দ্রাবাদের প্রত্যেকটা বিশ্বাসী হায়দ্রাবাদের জন্য লড়বে। এই ধর্মযুদ্ধে আমরা জিতব, আশা রাখি।”


রাজাকাররা সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে। মুখ্যত হিন্দু কৃষকরা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় শক্তি এবং তারাই লড়াই চালিয়ে যায়। বিজয়ওয়াড়া, বিশাখাপত্তনম, বিজয়নগরম, কাকিনাড়া, গুন্টুর ইত্যাদি জেলায় কমিউনিস্টরা হায়দ্রাবাদের রাজাকারদের বিরুদ্ধে দারুণ লড়াই দেয়, তাদের সাথে ছিল হিন্দু মহাসভাও। অন্যদিকে রাজাকারদের মধ্যে পাঠান ও আরবরা বিদার ও রায়চুরের দিকে অবিশ্বাসীদের সাথে চরম বর্বরতা করছিল। গণহত্যা, গণধর্ষণ কিছুই বাকি রাখে নি। এমনকি মেয়েদের উলঙ্গ করে রক্তাক্ত অবস্থায় জনসমক্ষে হাঁটতে বাধ্য অবধি করেছিল। এসব খবর যত বেরুতে থাকে, দাক্ষিণাত্য জুড়ে নিজামের অপশাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুরা ততই সরব হতে থাকে। কংগ্রেস নেতারাও চাপে পড়ে গিয়েছিল। এদিকে পাকিস্তান থেকে নৌপথে টন টন অস্ত্র আসতে শুরু করলে রাজাকারদের উৎসাহ আরও বাড়তে থাকে। তারা দক্ষিণে ওয়ারাঙ্গল ও বিদারে পাকিস্তানী অস্ত্র দিয়ে গণহত্যা চালাতে থাকে। 


১৯ আগস্ট নিজাম রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ চেয়ে বসেন হায়দ্রাবাদকে নিজের দখলে রাখার শেষ অস্ত্র হিসাবে। তিনি আশা করেছিলেন আরব দেশগুলি অন্তত তার পাশে দাঁড়াবে এবং তার স্বাধীন হায়দ্রাবাদের আশা পূর্ণ হবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে আশা চুরমার হয়ে গেল। রাষ্ট্রপুঞ্জে কোনও মুসলিম দেশ তার পাশে দাঁড়াল না, পাকিস্তান ছাড়া। সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকা ও ব্রিটেন এই প্রসঙ্গে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তখন বোঝা গেল, ভারত অবশ্যই সামরিক অভিযান পাঠাবে। ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হায়দ্রাবাদ অঞ্চলে যত বিদেশী ছিল (যার মধ্যে ৪০ আমেরিকান খৃষ্টান মিশনারিও ছিল), সবাইকে রয়্যাল এয়ার ফোর্স দিয়ে উদ্ধার করে সরিয়ে নেওয়া হল। ১১ সেপ্টেম্বর নিজামের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের অনুরোধ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান খারিজ করে দিলেন। এর কারণও ছিল যথেষ্টই। রাজাকাররা হায়দ্রাবাদ রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েকটা আমেরিকান চার্চে হামলা চালিয়ে সন্ন্যাসিনীদের ধর্ষণ করেছিল এবং সন্ন্যাসীদের হত্যা করেছিল স্রেফ অবিশ্বাসী বলে। এতে আমেরিকা খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছিল। এরপরেই নিজামের সেনাবাহিনীতে যতগুলি ব্রিটিশ ও বিদেশী সেনা আধিকারিক ছিলেন, একসাথে পদত্যাগ করলেন। তারপরেও নিজামের চৈতন্য হয় নি। তিনি ও কাশিম রিজভি ভেবেছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করতে তাদের বিশেষ অসুবিধা হবে না। 



India's Wars: A Military History, 1947-1971 by Arjun Subramaniam


কলমে: শ্রী অয়ন চক্রবর্তী।।


—————————————————————


ভারতের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা, যেখানে ঠেলায় পড়ে কম্যুনিস্টরাও মূষলমানদের সঙ্গে লড়াই করেছিল....। তাও আবার হিন্দু মহাসভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে!! 


# অপারেশন_পোলো ৩


আগেই বলেছি যে, ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম রাজ্য ছিল হায়দ্রাবাদ। ভারতের সাথে হায়দ্রাবাদের সীমারেখা ছিল প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার। এই কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ মোটেও সহজ ছিল না। ঐ সময়ে ভারত আরেকটা যুদ্ধে জড়িত ছিল — কাশ্মীর যুদ্ধ। কাশ্মীর যুদ্ধে জেনারেল থিম্মাইয়া লেহ ও পুঞ্ছ অঞ্চলে অসামান্য রণনিপুণত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। 


নেহেরু বুঝেছিলেন থিম্মাইয়াকে হায়দ্রবাদের দায়িত্ব দিলে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। সেজন্য তিনি জয়ন্তনাথ চৌধুরী নামে একজন বাঙ্গালী ব্রিগেডিয়ারকে হায়দ্রাবাদের দায়িত্ব দিলেন। জয়ন্তনাথ সে সময়ে নিউ দিল্লির আর্মি হেডকোয়ার্টারে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনিই অপারেশনের কোড নেম দেন, অপারেশন পোলো। এই নামের তাৎপর্য ছিল বৈকি — দুই রিজভির প্রিয় খেলা ছিল পোলো খেলা, যা ঘোড়ার পিঠে চেপে খেলতে হয়। জয়ন্তনাথ চৌধুরীর সাথে যারা ছিলে তা হলেন সাউদার্ন কম্যান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহারাজ শ্রী রাজেন্দ্র সিংহজি, এবং ওয়ান আরমার্ড ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং ইন চিফ রূপে পরিচিত আরেক বাঙ্গালী অজিত অনিল রুদ্র, মাদ্রাজ রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত মেজর জেনারেল পদমর্যাদাভুক্ত ছিলেন। 


লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজেন্দ্র সিংহজি ১৯৪১ সালে ২ রয়্যাল ল্যান্সার ও স্কোয়াড্রন কম্যান্ডার হিসাবে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ঐ বছরেই তিনি উত্তর আফ্রিকায় বিশেষ বীরত্ব দেখিয়ে ডিএসও পুরষ্কার লাভ করেন। তিনি মরক্কোয় জার্মান সেনাবাহিনীর মুখ থেকে বেশ কয়েক ডজন ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈনিককে উদ্ধার করে এনেছিলেন। ১৯২৮ সালে ‘ব্রিটিশ’ সেনাবাহিনীতে ভারতীয়কে সেনা আধিকারিক পদে নিযুক্ত করা শুরু হয় এবং জেনারেল পদে জয়ন্তনাথ চৌধুরীর মত এত কম বয়সে কেউই নিযুক্ত হয় নি। সিংহজির মতই জয়ন্তনাথও উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকায় জার্মানদের সাথে লড়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সুদান, এরিত্রিয়া ও পশ্চিম সাহারায় তার লড়াই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এরপর তাকে বর্মায় জাপানিদের সাথে লড়তে পাঠানো হয়েছিল। জয়ন্তনাথ ১৬ ক্যাভালরির দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব আফ্রিকা থেকে বর্মায় গেলেন ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। স্বাধীনতার আগে যে মাত্র তিনজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হয়েছিলেন, তার মধ্যে কারিয়াপ্পা, থিমাইয়া ও জয়ন্তনাথও ছিলেন। অন্যদিকে মেজর জেনারেল অনিল রুদ্র ছিলেন তৎকালীন ‘ব্রিটিশ’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে প্রবীণ জেনারেল। অনিল রুদ্র যুগপৎ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে লড়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ‘ব্যাটল অফ সোম্মে’র লড়াইতে তিনি ফ্রেঞ্চ ও বেলজিয়ানদের সাথে সমান তালে লড়েছিলেন জার্মানদের বিরুদ্ধে। সেখানেই তিনি জকি উপাধি পেয়েছিলেন দারুণ অশ্বারোহী ছিলেন বলে। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই ৪/৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশনিং অফিসারের পদোন্নতি পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও তিনি একই রকম ক্ষমতার সাথে লড়াই করে দেখান। তাকে জয়ন্তনাথের সাথে বর্মা যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল ১৯৪৪ সালেই। 


অপারেশন পোলো’তে বায়ুসেনার দায়িত্বে ছিলেন আরেক বাঙ্গালী ‘এয়ার কমোডোর’ সুব্রত মুখার্জি, তিনি এওসি ক্যাটাপিলার এয়ার টাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সুব্রত মুখার্জিই ছিলেন দ্য এয়ার স্টাফ বিভাগের প্রথমতম ভারতীয় প্রধান। ১৯৫৪ সালে তিনি এই সম্মান অর্জন করেন। অতীতে তিনি রিয়াল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের ১ স্কোয়াড্রন বাহিনীর প্রথমতম ভারতীয় কম্যান্ডিং অফিসারও ছিলেন। ফাইটার পাইলট হিসাবে তার খ্যাতি ছিল, নর্থওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে (আজকের পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে অবস্থিত) আফ্রিদি ও মাহসুদ উপজাতিদের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। তা এই সুব্রত মুখার্জি প্রথম নেহেরুকে প্রস্তাব দেন, নেহেরু সম্মত থাকলে তিনি বিমানে করে প্রথমে হায়দ্রাবাদ ঘুরে ঘুরে কোথায় কি হচ্ছে তার খবর নেবেন এবং তা থেকে অপারেশন পোলোর নীল নক্সা রচনা হবে। নেহেরু সুব্রত মুখার্জিকে ভালই চিনতেন। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। এরপরেই সুব্রত মুখার্জি দুই ফাইটার স্কোয়াড্রন ও ৪ ফাইটার বোম্বার নিয়ে পুণেতে (তখন পুণা) বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রচনা করতে লাগলেন। 


১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে দুপুর ১.৪৫ নাগাদ ‘ভারতীয়’ সেনাবাহিনী ভারতের চারটে প্রদেশ (সেন্ট্রাল প্রভিনস, বম্বে, মাইসোর এবং মাদ্রাজ) দিয়ে পাঁচ দিক দিয়ে হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করতে উদ্যত হল। ১৭২৭ সালে ১২ সেপ্টেম্বর মারাঠারা পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের নেতৃত্বে নিজামকে পরাস্ত করে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিল। সেই ঘটনাকে স্মরণে রেখেই ঐ দিনেই জয়ন্তনাথ চৌধুরী হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযান চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জেনারেল চৌধুরী ১ আরমার্ড ডিভিশনকে নিয়ে শোলাপুর-হায়দ্রাবাদ হাইওয়ে হয়ে বিদারে ঢুকে পড়ে রাজাকারদের অতি সহজে পরাস্ত করে বিদারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে নিজামকে একটা বার্তা পাঠালেন। এতে না থেমে হায়দ্রাবাদের দিকে এগোতে লাগল তার বাহিনী, এক সময়ে হায়দ্রাবাদও ভারতের সেনারা দখল করে নিলো। অন্যদিকে ১ আরমার্ড ডিভিশনের অতিরিক্ত বাহিনী উত্তরপশ্চিম হয়ে ঔরঙ্গাবাদ ও জালনা দখল করে নিলো। আরেকটা বাহিনী উত্তরপূর্বে ঢুকে পড়ে আদিলাবাদ দখল করে নিলো। দক্ষিণ দিক দিয়ে ১ আরমার্ড ডিভিশনের আরেকটি ফ্রন্ট কুরনুল ও দক্ষিণ পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বেজওয়াড়া দখল করে নিলো। এইভাবে পাঁচটা প্রান্ত দিয়ে একের পর এক হায়দ্রাবাদ ঘাঁটি বেহাত হয়ে যেতে লাগল। শেষ দুটো জয়ের নেতৃত্বে ছিল অনিল রুদ্রের মাদ্রাজ রেজিমেন্টের অন্তর্গত ইনফ্যান্ট্রি ও আরমার্ড ডিভিশন। 


***********


‘ভারতীয়’ সেনাবাহিনীর মত একটি পোড়খাওয়া ও একাধিক যুদ্ধে অভিজ্ঞ, পেশাদার বাহিনীর সাথে চূড়ান্ত অশিক্ষিত, ভাল অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ না থাকা হায়দ্রাবাদি রাজাকার বাহিনী আর কতক্ষণ যুঝতে পারবে? তার ওপর তাদের কারুরই কোনও প্রকার সত্যিকারের লড়াইয়ের কোনও অভিজ্ঞতাও ছিল না। তাদের কাছে যসব আগ্নেয়াস্ত্র ছিল তা অতিশয় পুরানো ও জং ধরা। তা দিয়ে আর যাই হোক, ৩০০০০ সংখ্যার একটি চূড়ান্ত পেশাদার সেনাবাহিনীর সাথে লড়া যায় না। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্য থেকে পুলিসও আনা হয়েছিল, যাদের সংখ্যা ছিল ৩৫০০০। সাথে প্রায় ৮০০০ সশস্ত্র কমিউনিস্টও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল পথ দেখিয়ে, তাদের সাথে লড়ে। পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের মতে, রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ৩০০০০ থেকে ৭০০০০ এর আশপাশে। রাজাকারদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয় প্রায় ৩০০০ মেয়েও ছিল। নিজামের হাতে কোনও বায়ুসেনা বা নৌসেনা ছিল না, যা নিঃসন্দেহে ভারতীয় সেনাকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল। নিজামের কাছে যেকটা পাকিস্তান থেকে আসা সাঁজোয়া গাড়ি এসেছিল, তা হায়দ্রাবাদের খারাপ রাস্তায় চলার অযোগ্য ছিল। 


জয়ন্তনাথ রাজাকারদের চরিত্র খুব ভাল ভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝেছিলেন, হায়দ্রাবাদের পার্বত্য অঞ্চলকে এরা গেরিলা লড়াইয়ের জন্য বেশ ভাল ভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এই কারণে তিনি এমন পাঁচটা এলাকা দিয়ে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে আশপাশে কোনও পাহাড় বা উঁচু জায়গা নেই। রাজাকাররা হিট-অ্যান্ড-রান পদ্ধতিতে লড়তে পটু ছিল বটে, কিন্তু সম্মুখ সমরে তারা একেবারে অপদার্থ ছিল। জয়ন্তনাথ চৌধুরী তাই কোনও ঝুঁকি নেন নি, সুব্রত মুখার্জিকে সাথে নিয়েছিলেন। রাজাকারদের সাথে লড়বার জন্য সব রকমের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। 


পাঁচদিক দিয়ে সামরিক অভিযান চালাবার পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার — রাজাকারদের মনোবল একেবারে চুরমার করে দেওয়া। পাশের মানচিত্র দেখলে পরিষ্কার হবে, কোন কোন দিক দিয়ে দিয়ে আক্রমণ করে রাজাকারদের হকচকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স হায়দ্রাবাদের মধ্যে যতগুলি ব্রিটিশ অধিকৃত এয়ারফিল্ড ছিল তা বোমাবর্ষণ করে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। সুব্রত মুখার্জি স্বয়ং ওয়ারাঙ্গল এয়ারফিল্ড স্বহস্তে ধ্বংস করেন। এছাড়া বিদার এয়ারফিল্ডও নষ্ট করে ফেলা হয়। ১ আরমার্ড ডিভিশন দৌলতাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ, আদিলাবাদ ও ওসমানাবাদ দিয়ে পাল্টা গেরিলা অ্যাটাক চালিয়ে রাজাকারদের স্তম্ভিত করে দেয়। অন্যদিকে কুরনুল ও হসপেট হয়ে রুদ্রের নেতৃত্বাধীন মাদ্রাজ রেজিমেন্ট হামলা চালায়। পাঁচদিক দিয়ে হামলা ছিল অত্যন্ত মেপেজুপে চালানো। নিখুঁত টাইমিং ছিল তাতে, যা সামলাবার ক্ষমতা রাজাকারদের ছিল না। সেজন্য দ্বিগুণ লোকবল নিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। 


মাদ্রাজ রেজিমেন্ট কুরনুল ও হসপেটের সব রাস্তা ও রেল লাইন এমনভাবে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল, যে রাজাকার বাহিনীদের অন্যত্র পালাবার কোনও উপায় ছিল না। দক্ষিণপূর্বে উর্বর তেলেঙ্গানা অঞ্চল সে সময়ে রাজাকার ও কমিউনিস্ট বাহিনীর লড়াইয়ের সাক্ষী ছিল। গোটা হায়দ্রাবাদের মধ্যে একমাত্র তেলেঙ্গানাই ছিল সম্পূর্ণ মুসলিম মুক্ত এলাকা। সেখানকার হিন্দুরা রাজাকারদের হাতে ‘জাতিগত সাফাই’ হবার আশঙ্কা থেকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে কমিউনিস্টদের সাথে লড়তে বাধ্য হয়েছিল। তেলেঙ্গানার এমন একটা পরিবার ছিল না, যাদের ছেলেমেয়ে রাজাকারদের সাথে লড়ছিল না। এদের মধ্যে লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে পুণে থেকে রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স ও আরমার্ড ডিভিশন রাজাসুর, জাহিরাবাদ, বিদার এবং হোমানাবাদ ইত্যাদি এলাকায় ঢুকে রাজাকারদের প্রতিরোধ চুরমার করে দেয়। অন্যদিকে বেজওয়াড়া হয়ে রুদ্রের বাহিনী রাজাকারদের শেষ ঘাঁটিও ভেঙ্গে দেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটা নাগাদ আরমার্ড ডিভিশন হায়দ্রাবাদ শহরকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। এবং উপায়ান্তর না দেখে নিজাম আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এইভাবে অপারেশন পোলো শেষ হয় অত্যন্ত সফল ভাবে। 



India's Wars: A Military History, 1947-1971 by Arjun Subramaniam


কলমে: শ্রী অয়ন চক্রবর্তী।।

Popular posts from this blog

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? কেন আমরা ব

ছেলেরা কেন দিনদিন 'বৌদিবাজ' হয়ে উঠছে?

সমাজটা খুবই খারাপ দিকে যাচ্ছে। ছেলেরা এখন বৌদিবাজ হয়ে উঠেছে! তারা একবার করে প্রেমে ছেঁকা খাওয়ার পর আর অন্য কোনও প্রেমিকা জোটায় না, বৌদিদের সাথে গল্প করে। কারণ - ১| ধোঁকা খায় না ২| হৃদয়ে আঘাত লাগে না ৩| Break up 💔 বলে কিছু থাকে না ৪| অনেকটা Stunt বাজীর মতো, মাথায় কোনো চাপ নেয়ার দরকার পরে না  আর একটা বিষয় হলো এখন বেশিরভাগ ছেলে পড়াশোনা দিকে ব্যস্ত। তাই তাদের হাতেও বেশি সময় থাকে না। আবার বৌদিদের হাতেও বেশি সময় সীমিত। তাই একটা Understanding বজায় থাকে। আরেকটা জিনিস হল নতুন প্রেমিকারা যেরকম নানারকম চাপ দেয়। বৌদীরা অনেকটা বোঝে ব্যাপারগুলো। যেমন- ফাঁকা পকেট, কম সময়, Relation Public না করা... এসব জিনিস। সেই কারণে তারা এতটা চাপ দেয় না। অল্পবয়সী মেয়ের একটু জেদি হয়। তাই তারা অকারণেই ঝগড়া করে যা এমনিতেই চাকরি আর ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত ছেলেদের ভালো লাগে না। তাই তারা বৌদিদের দিকেই ঝোঁকে। বিয়ে তো অবশ্য ভালো কোনো মেয়ে দেখেই করবে, তার আগের সময়টা অন্য দিকে দেয় - বৌদিদের সাথে আড্ডা মারে। বৌদিদের সাথে কথা বলে আর কিছু হোক বা না হোক মানসিক শান্তি আছে। আমার বৌদিবাজ বন্ধুদের জন্য 💖

রাষ্ট্রভক্ত বীরাঙ্গনা হীরা দে

 🌹💥🕉️ দুর্নীতিবাজদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তার উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে জানা যায়। এই শাস্তিও কোন রাজা বা সরকার দিয়েছিল না দিয়ে ছিল শুধুমাত্র তার পরিবারের সদস্যরা। 💢 1311 খ্রিস্টাব্দে, আলাউদ্দিন খিলজিকে জলোর দুর্গের গোপন কথা বলার জন্য পুরস্কার হিসাবে পাওয়া অর্থ নিয়ে ভিকা দাহিয়া আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন।এত টাকা এই প্রথম দেখল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল যুদ্ধ শেষ হলে এই টাকা দিয়ে একটা বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি করে আরামে বসবাস করবে।প্রাসাদের সামনে ঘোড়া বাঁধা থাকবে, চাকর থাকবে।  তার স্ত্রী হীরা স্বর্ণ ও রৌপ্য গয়না দ্বারা সারা শরীর ঢাকা থাকবে। আলাউদ্দিন কর্তৃক জালোর কেল্লায় নিযুক্ত সুবেদারের দরবারে তিনি বড় মর্যাদার বিবেচিত হবেন।বাড়িতে পৌঁছে বিড়বিড় করে হেসে টাকার বান্ডিলটা বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী হীরা দে'র হাতে।  🌹স্বামীর হাতে এত টাকা এবং স্বামীর মুখ ও অভিব্যক্তি দেখে হীরাদে আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যদের দিল্লি ফিরে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে জালোরের যুদ্ধে হতাশ হয়ে হঠাৎ জালোরের দিকে ফিরে যায়। হীরা দে বুঝতে পেরেছিলেন যে তার স্বামী ভিকা দাহিয়া তার জন্মভূমি জ