Skip to main content

আত্মহত্যা

 প্রায় ৩-৪ বছর আগে আমার পরিচিত পরিবারের একমাত্র মেয়েটি আত্মহত্যা করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটি ছিল খুব চুপচাপ স্বভাবের এবং একটু খুড়িয়ে হাঁটতো। কারো সঙ্গেই তেমন মিশতো না। খবর শুনে সবাই ছুটে গেল। মানুষ ফিসফাস করছে। মূল প্রশ্ন একটাই কেন মারা গেল? এই আত্মহত্যার পেছনের ঘটনা খুঁজতেই দেখলাম সবার উৎসাহ।


মেয়েটির মা কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছেন, "আমার বাচ্চাটা মারা গেল আমার সামনে। কেন আমি ওকে আরও সময় দিলাম না? নিশ্চয়ই আমার মেয়েটা খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই ও বলতো আমি খুব ভয় পাচ্ছি মা, কিন্তু বলেনি বা বলতে চায়নি যে ওর ভয়টা কী।"


ঠিক এরকম একটা সময়ে ভদ্রমহিলার খালা বলে উঠলেন, ‘তোর মেয়েটা স্বার্থপরের মতো চলে গেল। তোদের কষ্টটা ভাবল না।’ আমি সেখানে ছিলাম কিন্তু এ কথার কোনো উত্তর দেইনি। শুধু অবাক হলাম এই ভেবে যে, এখনো মানুষ মনে করে সুইসাইড করাটা স্বার্থপরের মত কাজ। কিন্তু কেন মনে করে? অন্য একজন মানুষ হিসেবে আমাদের পক্ষে খুব কঠিন ভিন্ন আরেকজনের মানসিক কষ্ট বুঝে, সত্যিকার অর্থে তা অনুভব করা।


অধিকাংশ মানুষ বুঝেই না বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন লোকে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। জানে না সিচুয়েশনাল অথবা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কথা। জানে না বাইপোলার, সিজোফ্রেনিয়া ও বর্ডারলাইন ডিজিজ কী? অনেক রোগী ডাক্তারকে বলেছেন যে, "তারা যখন আত্মহত্যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবেনি। কারণ তখন তাদের কাছে নিজেদের ব্যথাটাই খুব বেশি ছিল।" মনে হতেই পারে এটা খুব স্বার্থপরের মতো আচরণ। মানুষ আত্মহত্যা করে শুধু নিজে পালিয়ে বাঁচার জন্য, অন্য কারো জন্য মরে যাওয়াটা সুইসাইড নয়। সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়। তবে হ্যাঁ, একেকজনের কারণটা থাকে একেকরকম।


একজন ভদ্রলোকের হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়ার পর উনি আত্মহত্যা করেন। তার স্ত্রী বলেছিলেন, "জানেন চাকরি চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন সময় আমার স্বামী বলেছে, আমি মনে হয় তোমাদের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছি। আমি না থাকলেই তোমরা ভালো থাকবে। কেন বোঝা হচ্ছে, সে বিষয়ে কখনো কোনো উত্তর দিতো না। এখন আমার মনে হচ্ছে ওর মনের মধ্যে অনেক যন্ত্রণা ছিল। আমরাই বরং ওর মানসিক যন্ত্রণাটা নিয়ে কখনো ভাবিনি। ওকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নেইনি। ও কখনো স্বার্থপরের মতো মরে যাওয়ার কথা ভাবেনি, ভেবেছে আমাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য। আমরা ওকে বুঝাতে পারিনি তুমি একা নও।"


কিছুদিন আগে একটি কিশোর বাবা-মায়ের ঝগড়া মেটাতে গিয়ে সুইসাইড করল। বলিউডের সাড়াজাগানো নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুত চলে গেল বিত্ত-বৈভব-খ্যাতি ছেড়ে। নেপালে মার্চ থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের প্রথম ৭৪ দিনে আত্মহত্যা করেছে ১,২২৭ জন, ভারতে ৯ জন শ্রমিক কাজ হারিয়ে একসঙ্গে কুয়ায় লাফিয়ে পড়ে মারা গেল। ১২ বছরের বাচ্চাকে বাবা বকেছে বলে রাগে-দু:খে বাচ্চাটি ফ্যানে ঝুলে পড়ল। এসএসসিতে ভালো নম্বর না পাওয়ায় ১০ জন শিশু আত্মহত্যা করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ থেকে ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী পরপর আত্মহত্যা করল। বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক দিতে না পারায় দুঃখে গৃহবধূ গলায় ফাঁস দিল।


এদের চলে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, মূল কারণ কিন্তু একটাই, আর সেটা হচ্ছে "চাপ, বিষণ্ণতা এবং হতাশা", যা তারা বহন করতে পারেনি।


সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন, "আত্মহত্যা একটি সামাজিক বিষয় বা ফেনোমেনা। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সেদেশেরই সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের মনো-সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলে, "মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিস্বরুপ।" মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকরা বলেন, "হতাশা ও দুশ্চিন্তায় সাইকোসিস (মনোবৈকল্য) এবং সিজোফ্রেনিয়া ৩ থেকে ৫ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।"


আত্মহত্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক ভুল ব্যাখ্যা, ভয় এবং কুসংস্কার কাজ করে। প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে যিনি আত্মহত্যা করেন, তার নিজস্ব কিছু কারণ থাকে। প্রতিটি মানুষ আলাদা, আবেগ-অনুভূতিও আলাদা। আমি যেভাবে পৃথিবীকে দেখি, আরেকজন সেই দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখবে না। তাই কেউ কেন সুইসাইড করল, এটা চট করে বলা খুব কঠিন। ডাক্তাররা কারণ বের করার চেষ্টা করেন, কিন্তু একজন মানুষের মনের মধ্যে ঠিক কী ঘুরছে এটা বোঝা কঠিন। কেন সে এই সময়ে আত্মহত্যা করলো এটা জানাও প্রায় অসম্ভব।


স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম সেই ১৭ শতকে তার ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষ কখনোই তার জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জীবনটা তার কাছে মূল্যবান থাকে।’ অনেক কিছুই একজন ব্যক্তির বোঝার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং পরিবেশকে নাড়াচাড়া করতে পারে, কেন সে নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নেয়, তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না। আমরা জানতে পারব না একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনা ও যুক্তি ঠিক ওই মুহূর্তে বা সুইসাইড করার আগের মুহূর্তে কী থাকে।


মনোচিকিৎসক ক্যাম্পবেল ওয়াট বলেছেন, ‘এটা আমাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব যে একজন মানুষকে তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছার হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা যদি সফল হই, যদি ব্যক্তির কারণগুলোকে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই হবে বড় উপহার।’


তবে মনোচিকিৎসকরা এও বলেন- তারা দেখেছেন যখন রোগীদের মানসিক, শারীরিক ও আবেগজনিত অসুস্থতা চিকিৎসা করা হয়, তখন সেই সব সুইসাইডাল রোগীরা আর মারা যেতে চায় না। অনেকেই ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। ফিরে এসে তারা বলেছেন- তারা জীবন উপভোগ করতে চান। তারা স্বীকার করেছেন বিশেষ একটা অবস্থায় তারা মারা যেতে চেয়েছিলেন। তাহলে আমাদের সবার দায়িত্বটা হচ্ছে, মানুষের ওই মুহূর্তটাকে ঠেকানো, তার পাশে দাঁড়ানো।


ক্যাম্পবেল ওয়াট আরও মনে করেন, যে মারা যায় তার মৃত্যু তার পরিবারের ওপর ভয়াবহ প্রভাব রাখে। কারণ তার এই চলে যাওয়াটা তার একার বিষয় নয় এবং মৃত মানুষের পরিবার-পরিজন সারাজীবন একটা উত্তরবিহীন প্রশ্ন, অতৃপ্ত মন এবং গভীর শূন্যতা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়।


বিশিষ্ট নারী অধিকারকর্মী কামলা ভাসিনকে দেখলে মনে হবে পৃথিবীর এক দিকের ভার টেনে উনি অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারেন। অথচ মন থেকে এতগুলো বছরেও মুছে ফেলতে পারেননি মেয়ে হারানোর ব্যথা। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মেয়ে মিতু মাত্র ২৭ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে যখন চলে যায়, তখন সে অক্সফোর্ডে পিএইচডি করছে। একটা সম্পর্ক ছিল ওর, রেজাল্টও ভালো ছিল। কিন্তু সে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভুগছিল। ফলে সে আত্মহত্যা করে। আমার মনে হয় অধিকাংশ মানুষই মনে করে না যে হতাশা এক ধরণের অসুস্থতা। সবাই জানতে চায় কেন আত্মহত্যা করেছে, কারা এজন্য দায়ী? যাই হোক আমিও বলতে চাই যে- আমি জানিনা কেন ও চলে গেল?


মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন আত্মহত্যা দু’ধরণের হয়, পরিকল্পিত এবং আবেগতাড়িত হয়ে বা কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চরম বিষণ্ণতা বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে। অধিকাংশ মানুষ খুব একটা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করে না। বিষণ্ণতা থেকে আবেগ তৈরি হয়, আশা চলে যায়, অন্য কোনো উপায় খুঁজে পায় না মানুষ, একমাত্র উপায় হয় তখন নিজের জীবন নিয়ে নেওয়া। সুইসাইড করার অর্ধেক কারণই হচ্ছে বিষণ্ণতা বা অবসাদ।


এ ছাড়া, শিশুকালে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, সংসারের দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধের স্মৃতি মানুষের ওপর ভীতিজনিত চাপ তৈরি করে, যা আত্মহত্যার কারণ হতে পারে, এমনকি অনেকদিন পরে হলেও হতে পারে। মাদক ও মদ্যপান মানুষের সুইসাইডের আশংকা বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া, সম্পর্ক ভেঙে গেলে, চাকরি হারালে, আয়ের পথ না পেলে, সামাজিক পজিশন হারালে, ফেল করলে, লজ্জা পেলে, বুলিং ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হলে, আটক হলে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। ক্রমাগত অসুস্থতাও আত্মহত্যার কারণ, তবে কম। 


বিশ্বে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১৯৬০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে শতকরা ৬০ ভাগ। উন্নয়নশীল দেশে এই হার বেশি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে কেন দিনে দিনে আমাদের দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। কারণ আমরা আত্মহত্যার কারণগুলোকে আমলে নেই না বা গুরুত্ব দেই না। এটা যে সাধারণত মানসিক অসুস্থতা বা চাপ থেকে হয়, সেটাও অধিকাংশ পরিবার জানে না। আর জানলেও এটা জানে না যে, এই মানসিক রোগীকে নিয়ে কী করতে হবে। কীভাবে তার পাশে দাঁড়াতে হবে? আমাদের কাছে মানসিক সমস্যা বা চাপ মানে পাগল হয়ে যাওয়া। এর জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাওয়া।


অথচ প্রায় ২৭ ভাগ থেকে ৯০ ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। পরিবারের কোনো সদস্য কোনো বিপদে পড়লে পরিবারের অন্য সদস্যরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে, বরং গালিগালাজ করে। তাকে একঘরে করে বিষণ্ণতার মুখে ঠেলে দেয়।


আমরা সবাই এখন ইঁদুর দৌঁড় প্রতিযোগিতায় আছি। এই প্রতিযোগিতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের হতাশা ও বিষণ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দিচ্ছে। পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানুষকে আরও চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।


আমাদের সন্তানদের মানিয়ে নেওয়া শেখাতে হবে। বিপদে তাদের পাশে থেকে সময় দিতে হবে। কোনো অপরাধের জন্য কাউকে ধিক্কার জানানোর মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। নিজেদের অপ্রাপ্তি সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কেউ যদি বিষণ্ণতায় ভোগে, তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সময় মতো কারো পাশে দাঁড়ালে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে একজন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সরকারকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে আমলে নিয়ে জাতীয় সুইসাইড প্রিভেনশন কৌশল দাঁড় করাতে হবে।


একজন শিক্ষক হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে বললেন, বলতো এই গ্লাসে ঠিক কতটা পানি ধরে থাকলে আমার হাত অবশ হয়ে যাবে? তারা বলল ৯, ১০ বা ১২ আউন্স। শিক্ষক বললেন, না এখানে পানির ওজন কোনো ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে আমি কতক্ষণ এই গ্লাসটা ধরে আছি। ৫/১০/২০ মিনিট নাকি সারাদিন? যতো বেশি সময় ধরে থাকব, ততো বেশি আমার হাতটা অবশ হতে থাকবে। সারাদিন ধরে থাকলে, হাত একেবারেই অবশ হয়ে যাবে। তাই আমাদের দায়িত্ব হবে এই পানি ভর্তি গ্লাসটাকে হাত থেকে রেখে দেওয়া। এই পানি ভরা গ্লাসটার মতোই হলো স্ট্রেস বা চাপ। আমরা যদি সারাক্ষণ ভাবি, তাহলে আমরা অবশ হয়ে যাব এবং কিছুই করতে পারব না। তাই চাপ বা স্ট্রেসকে সরিয়ে রাখাই ভালো।


🌸শাহানা হুদা রঞ্জনা,

সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর,

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন