বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ সমাজে পাঁচটি শাখা রয়েছে — রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও মধ্যশ্রেণী।
বাঙ্গালি কায়স্থ সমাজে রয়েছে চারটি শাখা — উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ।
এই সকল বর্ণ এবং তাদের শাখা ও উপশাখাগুলির মধ্যে বিবাহ প্রথায় দুটি বিভাগ দেখা যায় — বৈদিক ও লৌকিক।
লৌকিক প্রথাগুলি মেয়েলি আচার। এই কারণে এগুলি ‘স্ত্রী আচার’ নামে পরিচিত। বৈদিক আচারে সাম, যজুঃ ও ঋক্ বেদত্রয়ের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ প্রথায় আবার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।
হিন্দু বিবাহের বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অপরিহার্য হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম (লাজ বা খই দিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান), সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ (কন্যার পাণি অর্থাৎ হস্ত গ্রহণ), ধৃতিহোম (ধারণ করার অর্থাৎ কন্যাকে ধরে রাখার যজ্ঞ) ও চতুর্থী হোম। এছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন, ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন, শিলারোহণ ইত্যাদি কয়েকটি বৈদিক প্রথাও।
বৈদিক প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ।
বাঙালি হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়।
"বিবাহ”
শব্দটি বি-পূর্বক বহ্ ধাতু ও ঘঞ্ প্রত্যয়যোগে গঠিত। বহ্ধাতুর অর্থ বহন করা এবং “বি” উপসর্গের অর্থ বিশেষরুপে।সুতরাং বিবাহ শব্দের অর্থ বিষেশ রুপে বহন করা। বিবাহের ফলে পুরুষ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মানসম্ভ্রমরক্ষার সার্বিক ভার বহন করতে হয়।
স্মৃতি শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ মনুসংহিতায় আট প্রকার বিবাহের কথা বলা আছে।
সেগুলো হল:-
(১) ব্রাহ্ম
(২) আর্য
(৩) প্রাজাপত্য
(৪) আসুর
(৫) গান্ধর্ব
(৬) রাক্ষস
(৭) দৈব
(৮) পৈশাচ
জাতি এবং শ্রেণী বিভাগে এই বিবাহ গুলো হয়ে থাকে তবে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য বিবাহ রীতি গুলোই প্রচলিত।
বর্তমান মানব সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত এবং পালনীয়।
ব্রাহ্ম বিবাহ হল – কন্যাকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে এবং অলংকার দ্বারা আচ্ছাদন করে বিদ্বান ও সদাচারী বরকে স্বয়ং আমন্ত্রন করে যে কন্যা দান করা হয়তাকে ব্রাহ্মবিবাহ।
বর্তমানে কেউ না মানলেও সমাজে গান্ধর্ব বিবাহের প্রচলন আছে।
নারী-পুরুষ পরস্পর শপথ করে মাল্যবিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে তার নাম গান্ধর্ব বিবাহ।
এর উদাহরণ, মহাভারতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিবাহ গাদ্ধর্ব বিবাহ ছিল।
বেদে খুব পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছেঃ
উদীর্স্বাতো বিশ্বাবাসো নমসেলামহে ত্বা ।
অন্যামিচ্ছ প্রফর্ব্যং সং জায়াং পত্যা সৃজ ।।১০/৮৫/২২।।
—অর্থাত্ তুমি যাও ও অবিবাহিত নারীকে তোমার অর্ধাঙ্গিণী কর এবং তাকে সমান অধিকার প্রদান কর।
আমাদের সনাতন বিবাহে কত গুলো বিধিবিধান শাস্ত্রীয়, কিছু অনুষ্ঠান আচার রয়েছে। শুভলগ্নে নারায়ণ, অগ্নি, শিব, দূর্গা, গুরু ইত্যাদি দেবতাকে আহবান করে এবং পুরোহিত আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষী করে মঙ্গল মন্ত্রের উচ্চারণ, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বিয়ের মন্ত্রের শেষ হয় যজ্ঞের মাধ্যমে।
পাটিপত্র :
পাটিপত্র বাঙালি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।
পানখিল :
পানখিল বাঙালি হিন্দু বিবাহের দ্বিতীয় আচার। এটি পাটিপত্রের ঠিক পরেই পালিত হয়। পানখিলের অর্থ পান পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খিল দেওয়া বা খড়কে বেঁধানো। এই আচারটি প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পানখিল আচারে বাড়ির মেয়েরা এবং প্রতিবেশিনীরা বিয়ের গান গেয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হল রাম ও সীতার বিবাহ।
দধি মঙ্গল :
দধি মঙ্গল: বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্য্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিড়ে ও দৈ খাওয়ানো হয়।
গায়ে হলুদ :
গায়ে হলুদ: সংস্কৃত ভাষায় এই রীতিকে বলা হয় গাত্রহরিদ্রা। হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়। যেমন শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদি। প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ কন্যার বাড়ি পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো হয়।
শঙ্খ কঙ্কন :
শঙ্খ কঙ্কন: কন্যাকে শাঁখা পরানো হয়।
এরপর বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়
বর বরণ :
বর বরণ: বর বিবাহ করতে এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষ। সাধাবনত: কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান দুর্ব্ব ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। এরপর বরকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয় ।
সাত পাক :
সাত পাক: বিবাহের মণ্ন্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়। সাধারণত: কন্যার জামাইবাবুরা পিঁড়ি ধরে থাকেন। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়।
শুভদৃষ্টি :
শুভদৃষ্টি: বিবাহের মন্ডপে জনসমক্ষে বর ও কন্যা একে অপরের দিকে চেয়ে দেখন।
মালা বদল :
মালা বদল: কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। মুসলমান মতে একই ভাবে কন্যাকে বলতে হয় "কবুল"। আবার ঠিক এই রকমই খৃষ্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সন্মতি জানান।
সম্প্রদান :
সম্প্রদান: কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরন পোষনের দ্বায়িত্ব নিলেন।
বিবাহের মন্ত্র হল :
" যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।"
যদেতৎ-যেখানে
হৃদয়ং- হৃদয়
তব-তোমার
তদস্ত্ত - সেখানে
হৃদয়ং- হৃদয়
মম- আমার
যদিদং যেখানে
হৃদয়ং- হৃদয়
মম- আমার
তদস্ত্ত-সেখানে
হৃদয়ং- হৃদয়
তব - আমার
অঞ্জলি :
অঞ্জলি: কন্যা ও বর খৈ অগ্নাহুতি দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খৈ পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম।
সিঁদুর দান :
সিঁদুর দান: বিবাহের শেষ রীতি হল বর কন্যার কপালে সিঁদুর লেপন করেন। বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন।
লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে
পার্থক্য লক্ষিত হয়।
.কলমেঃ বহ্নি চক্রবর্তী
তথ্য সূত্র: আশুতোষ ভট্টাচার্য, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, নতুন দিল্লি,
ইন্ডিয়া....