Skip to main content

মনুবাদ এবং হিন্দু-সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কথা

 

✍ অর্ক ব্যানার্জি


আজকাল একটা কথার প্রচলন হয়েছে - "দলিত সমাজ" অত্যাচারিত, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত এবং এই অত্যাচারের ফলেই নাকি বহু নিম্নবর্ণের হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়েছেন - বলা ভালো মুসলিম হয়েছেন, খ্রিস্টান হয়েছেন - সেই বহুকাল আগে থেকে ।হিন্দু সমাজ বা হিন্দু সংস্কৃতি নাকি ব্রাহ্মণ্যবাদী ?


একটু আদিকাল থেকে দেখে আসা যাক।

শ্রুতি থেকে বেদ যখন লিপিবদ্ধ হয় - যিনি লিপিবদ্ধ করেন - সেই ব্যাসদেব, তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না । ব্রাহ্মণ যখন পৈতাধারণ করেন, তাঁকে যে "গায়ত্রী" মন্ত্র জপ্ করতে হয়, সেই গায়ত্রী মন্ত্রের যিনি দ্রষ্টা - মহর্ষি বিশ্বামিত্র - তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না।দেবতারা যাঁর সাহায্যে - স্বর্গ পুনরুদ্ধার করেন এবং যাঁর আত্মত্যাগ জগৎস্বরণীয়, সেই দধিচি মুনি - শূদ্র ছিলেন - ব্রাহ্মণ ছিলেন না । যাঁকে দক্ষিণ ভারতের উদ্ধারকর্তা বলা হয় - সেই অগস্ত্যা মুনি - শূদ্র ছিলেন, ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! এরপরেও হিন্দু সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী ?


ত্রেতাযুগে রচিত রামায়ণ - যিনি রচনা করলেন - মহাঋষি বাল্মীকি, ব্রাহ্মণ ছিলেন না। রামায়ণে সব থেকে শ্রদ্ধেয় চরিত্র - রাম, ক্ষত্রিয় ছিলেন - ব্রাহ্মণ নয় ! শ্রীরামের যুদ্ধ যাঁর বিরূদ্ধে - তিনি রাবণ, রাবণ ব্রাহ্মণ ছিলেন ! এরপরেও হিন্দু সংস্কৃতি - ব্রাহ্মণ্যবাদী ?


মহাভারতে তিন নীতির যুদ্ধ ! ধর্মনীতি, রাজনীতি এবং কূটনীতি ! ধর্মনীতি যিনি ধারন করে আছেন তিনি শ্রীকৃষ্ণ ! রাজনীতি যিনি ধারন করে আছেন - তিনি মহামতি বিদুর ! আর কূটনীতির ধারক - শকুনি ! ভারতীয় সভ্যতার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী যাঁকে বলা হয় - সেই মহামতি বিদুর - ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! মহাভারত যুগে শ্রীকৃষ্ণের পর যিনি সব থেকে জ্ঞানী ব্যক্তি - সেই মহামতি বিদুর শূদ্র ছিলেন - ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! এরপরেও হিন্দু সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী ?

 

প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ তিন রাজবংশ - নন্দ বংশ (শূদ্র), মৌর্যবংশ (শূদ্র) এবং গুপ্ত বংশ (বৈশ্য) ! এঁরা কেউ ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! এরপরেও যাঁদের রাজত্বের বিস্তৃতি, প্রায় মোগলদের রাজত্বের সমান বিস্তৃতি ছিলো - সেই পালবংশও ব্রাহ্মণ ছিলো না! এমন কি সেন বংশও ব্রাহ্মণ ছিলো না ! 


তাহলে কখন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করেছিলো বলতে পারেন ? যখন প্রাচীন সব গল্পেই দেখা যায়, দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হচ্ছেন, ঘরে ব্রাহ্মণপত্নী পথ চেয়ে আছেন কখন ব্রাহ্মণ ফিরবেন ভিক্ষা নিয়ে, তারপর রান্না হবে, সেই ব্রাহ্মণগণ অত্যাচারী ছিলো?


আধুনিক যুগের ভারতের দিকপুরুষ যিনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য এবং যিনি রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা প্রণবানন্দ মহারাজ ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! আজ সারা বিশ্বে শ্রীকৃষ্ণ নামমাহাত্ম্য বিতরণ, মন্দির প্রতিষ্ঠা হচ্ছে যেই সংঘঠনের মাধ্যেমে সেই "ইসকন" এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদ ব্রাহ্মণ ছিলেন না ! তাহলে বলতে পারেন কোথায় এই সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী ?


হ্যাঁ এঁরা সকলেই নিজ কর্ম গুনে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, এবং কর্ম দ্বারাই ব্রাহ্মণ ! গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন "চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"। তিনি গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে চারিবর্ণের সৃষ্টি করেছেন ! চার জাতি নয় !


আমাদের সংস্কৃতি কখনো কারও মাঝে বিভেদ রাখেনি ! নাহ্ - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র - কারো মাঝে না ! ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ শংকরাচার্য যেমন মেথরকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পিছপা হননি, তেমননি আমাদের সংস্কৃতি পিছপা হয়নি শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণকে সন্মান জানাতে ! আমাদের সংস্কৃতি - ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শংকরাচার্য, রামকৃষ্ণদেব, চৈতন্য মহাপ্রভু, সবাই কে সন্মান দিয়েছে - তাঁদের কৃতকর্মের জন্য ! 


তবে কি সেই সমাজে বা এই সমাজে বিভেদ ছিলো না ,অত্যাচার ছিলো না ? অবশ্যই ছিলো - সেটা ধনী দরিদ্রের বিভেদ, দরিদ্রের উপর ধনীর অত্যাচার ! তাহলে কেনই বলা হয় উচ্চজাতির প্রতি নিম্নজাতির অত্যাচার ছিলো ? কারণ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি হওয়া একটি চক্রান্ত যা আড়াইশত বছর পূর্বে আরও জোরদার হয় এবং এই হিন্দুসমাজকে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যা আজও সমান তালে চলছে । না হলে বলুন তো প্রায় দু'কোটি "মতুয়া" সম্প্রদায়কে কেনো ইসলামিক পূর্ব-পাকিস্থান বা ইসলামপ্রধান বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে ভারতে আশ্রয় নিতে হয় ? যদি উচ্চবর্ণের অত্যাচারে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা মুসলিম হয়ে থাকে তবে আজও কেনো বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসতে হয় -  প্রধানতঃ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ? বাংলাদেশ সংলগ্ন বর্ডারসাইট গুলি লক্ষ্য করুন , দেখবেন, বেশীর ভাগই তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু ! কেনো তাঁরা আজও মুসলিম নয় ? কারণ - যা আমাদের ইতিহাস পাল্টে গুলে খাওয়ানো হচ্ছে তা ভুল ইতিহাস ! উল্লেখ করা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্থানের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কথা । "দলিত-মুসলিম ঐক্য" স্লোগানের মহান প্রাণ পুরুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু হায় ,তাঁকেও রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো হিন্দু অধ্যুষিত ভারতেই, তিনি ক্ষমা পাননি - নিম্ন বর্ণের হিন্দু হলেও ।


কোন সমাজ  ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলো ? কিভাবে ছিলো ? যেখানে হিন্দুদের সাতটি গোত্রই চতুর্বর্ণে দেখা যায় ! যেমন ভরদ্বাজ গোত্র, ব্রাক্ষণের যেমন আছে তেমনি শূদ্রদেরও আছে ! কাশ্যপ গোত্র - ব্রাক্ষণ থেকে শূদ্র সবার মধ্যে আছে ! এতেই কি প্রমাণ হয় না - হিন্দুরা সাম্য ? হ্যাঁ হিন্দুরা অবশ্যই সাম্যবাদী I কারণ এই সংস্কৃতিই জগতের সকলের মঙ্গলার্থে এবং কোন ভেদ না করে - স্বগর্বে ঘোষনা করতে পারে -

ওম্ সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ, সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিতদুখভাগভবেত। ওম্ শান্তি শান্তি শান্তি।


প্রাচীন তিনটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র, তক্ষশিলা - নালন্দা - কাশীতে দেখুনতো ক'জন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন আর ক'জন অব্রাহ্মণ পণ্ডিত ! তারপরেও এই সংস্কৃতি নাকি - ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ?


 সর্বশেষ উদাহরণ দলিত সম্প্রদায়ের - রামজি মালোজী শাকপাল ও ভীমারাই'র চৌদ্দতম তথা কনিষ্ঠ পুত্র ভীমরাওকে যিনি পুত্ররূপে "ভীমরাও আম্বেদকর" নামে সারা পৃথিবীকে চিনিয়েছেন - তিনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের "মহাদেব আম্বেদকর" (লক্ষ্য রাখুন - আম্বেদকর পদবীটি মারাঠি ব্রাহ্মণ পদবী) এবং যিনি বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকরকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছিলেন, তিনি বরদা'র মহারাজা - শাহজী রাও একজন ব্রাহ্মণ ! 


হিন্দু সংস্কৃতিকে ভাঙতে যাঁরা তখন থেকে এখন একই ভাবে চক্রান্ত করে গিয়েছেন তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার সময় এখনই ! কারণ আপনিও আপনার কর্মগুনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, জন্মগত ননI


ব্রাহ্মণ আমার ভাই - চন্ডাল আমার ভাই - সবার শরীরে মানুষেরই রক্ত !

                               - স্বামী বিবেকানন্দ