Skip to main content

ভারতে সতীদাহ : পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা

ব্রিটেনে বছরে কতজন মহিলা আত্মহত্যা করে, জানেন?  

প্রতি ১,০০,০০০ জনের মধ্যে ৫.৪ জন। ০.০০৫ %। (Source : Statista Research Department, Oct 26, 2022)

আমেরিকায়, বছরে কতজন বন্দুকবাজিতে প্রাণ হারায়, কোন ধারণা আছে? প্রতি ১,০০,০০০ জনের মধ্যে ১৩.৬ জন। - ০.০১৩ %। (Source : Pew Research Center, 2020) 


এসবের কোথাও কোন ট্যাঁফো শুনতে পান? অথচ, দু'শো বছর আগে ০.০০২% ভারতীয় বিধবাদের সহমরণে ব্রিটিশ মিশনারীরা মরাকান্না জুড়ে দিয়েছিল। আর সেই কান্নায় ব্যাকুল হয়ে, বড়লাট লর্ড বেন্টিংক আইন এনে 'সতীদাহ' বন্ধ করলেন ১৮২৯ সালে। 'ডেটা সাইন্টিস্ট' শুভদীপ মুখোপাধ্যায়, 'সতীদাহের' ওপর হিসেব করে দেখিয়েছেন, যদি ধরেও নেওয়া হয়, ৯৫% 'সতীদাহে'র ঘটনা কোন খবরে আসেনি, তাহলেও প্রতি ৫০,০০০ জনের মধ্যে ১জন 'সতী' হতেন। শতকরা ০.০০২%। প্রতি একশো জনের মধ্যে  পুরো একজনও না।

 

ভারতীয় সমাজে, 'সতীদাহ' কখনোই কোন 'প্রথা' ছিলনা। 'সতীদাহ' বা সহমরণ, হিন্দুদের কোন আচারবিধির মধ্যেও পড়ে না। তবে সহমরণের ঘটনা কিছু কিছু ঘটত। এই নিয়ে, ব্রিটিশ মিশনারীরা এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, যেন 'সতীদাহ', হোলির নেড়াপোড়ার মত, যেখানেসেখানে, আকছার হত। খ্রীষ্টান মিশনারীরা একনাগাড়ে  এইসব আজগুবি গল্প রটাচ্ছিল। 


দ্বাদশ শতক অবধি বাঙ্গালায় 'সতীদাহের' কোন নজির (epigraphic evidence) নেই। জীমূতবাহন (১২শ শতক) তার দায়ভাগ আইনে লিখছেন, স্বামী মারা গেলে, তার বিধবা পত্নী, স্বামীর সম্পত্তি পাবে। সেই বিধবা পত্নী কীভাবে সেই সম্পত্তি তার সন্তানদের ভাগ করে দেবে, তা-ও দায়ভাগ আইনে বলা হয়েছে। কোথায় সহমরণের উল্লেখ? বিধবা পত্নী সহমরণে গেলে, সম্পত্তি পাবার প্রশ্ন উঠবে কেন?


কিন্তু মিশনারীদের আটকাবে কে? ১৮১৩ সালের আগে পর্যন্ত, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি, ভারতে,, তাদের সীমানার মধ্যে কোন ব্রিটিশ মিশনারীকে ঢুকতে দিতনা। কোন মিশনারী, এসে পড়লে, কোম্পানির লোকজন তাকে তাড়িয়ে দিত। মিশনারীরা তখন ফরাসী (যেমন চন্দননগর) বা ডেনিশ (যেমন শ্রীরামপুর) উপনিবেশগুলিতে গিয়ে মাথা গুঁজত। তাই, ব্রিটিশ ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা ব্রিটেনে বসেই রটাতে লাগল, ভারতের বাঙ্গালায় নাকি 'সতীদাহ' খুব ঘটছে।


১৮১৩ সালে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ভারতে, খ্রীষ্টান মিশনারীদের থাকার অনুমতি দিল। আর ভারতে খ্রীষ্টান মিশনারীদের আগমন শুরু হল। সাথে সাথেই, তাদের রটনায়, 'সতী'র ঘটনাও বাড়তে লাগল। বেড়ে গিয়ে হল, বাৎসরিক ১০,০০০! কোন কোন মিশনারী, সংখ্যাটা, বছরে ৫০,০০০ করে দিল। অথচ ১৭০০ থেকে ১৮০০'র মধ্যে, এই ১০০ বছরে, 'সতী'র ঘটনা ঘটেছিল ১৭৪২, ১৭৭০,১৭৭৯, ১৭৯৩ এবং ১৭৯৯ সালে -- মাত্র ৫বার। এগুলো ইউরোপীয় নথিই বলছে। এরপর ভারতবর্ষের সরকারি নথি বলছে, ১৮১৫ থেকে ১৮২৯, এই ১৫ বছরে, সারা ভারতে, ৮১৩৪ টা 'সতীদাহের' ঘটনা ঘটেছিল। মানে বছরে ৫৪২টার মত।  


মিশনারীরা কীরকমভাবে 'সতীদাহের' তথ্য সংগ্রহ করত, একটা নমুনা দিই : ১৮০৩ সালে, (তখনও তারা কোম্পানির এলাকায় থাকার অনুমতি পায়নি) মিশনারীরা ১০ জন লোককে ঠিক করল, কলকাতার আশেপাশে ক'টা 'সতী' হচ্ছে, তার হিসেব নিতে। কলকাতা ও তার পাশের ৩০ কিলোমিটার জুড়ে খোঁজখবর করে জানা গেল, ৪৩০টা ঘটনা ঘটেছে। এই পরিসংখ্যানকে ভিত্তি ধরে, মিশনারীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল মিলে, হাজার হাজার 'সতী'র ঘটনা ঘটছে। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ ব্যাপটিস্ট মিশনারী, উইলিয়াম কেরী (William Carey), শ্রীরামপুরে বসে (কী করবে? ব্রিটিশ কোম্পানির লোকেরা তো ব্রিটিশ এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না), নিজের দেশে চিঠি লিখলেন, প্রতি বছর, ভারতে ১০,০০০ জোরজবরদস্তি 'সতীদাহ' হচ্ছে। একের পাশে ইচ্ছে মত শূন্য বসিয়ে দিলেন কেরী সাহেব। আরেক দিগগজ, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক জুনিয়ার অফিসার, চার্লস গ্রান্ট (Charles Grant) তো তার বইয়ে আগেই লিখে দিয়েছিলেন, প্রতিবছর ভারতবর্ষে ৩৩,০০০ 'সতীদাহ' হচ্ছে। (চার্লস গ্রান্টকে নিয়ে একটা পর্ব থাকবে)।


মিশনারী প্রোপাগাণ্ডার প্রতিবাদ এল সরকারী তরফেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চার্লস লাশিংটন (Charles Hugh Lushington) এককথায় এইসব ভিত্তিহীন পরিসংখ্যান উড়িয়ে দিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের  স্যার খ্রিস্টোফার বেইলি (Sir Christopher Allan Bayly) লিখলেন, ১৮১৭ থেকে ১৮২৭ অবধি, এই দশ বছরে, ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলে ৪৩২৩ জন বিধবা 'সতী' হয়েছিল। উনি আরও লিখেছিলেন, কলকাতার আশেপাশে 'সতীদাহের' ঘটনা, বলতে গেলে, ঘটতই না। মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সীর জজেরাও সায় দিয়ে বললেন, তাদের সীমানায়, 'সতীদাহ' অত্যন্ত অল্পসংখ্যক হয়েছিল।


যত 'সতীদাহ' নজরে পড়ত, ব্রিটিশ ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের। রবার্ট পীয়ার্স (Robert Pearce) লিখলেন, ১৭৫৬ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যে ৭০,০০০ মহিলার প্রাণ গেছে 'সতীর' চিতায়। ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীরা তাদের 'ইণ্ডিয়ান জার্ণালে' প্রচার করলেন, কেবল ১৮২৯ সালেই ১,০০০,০০০ 'সতীদাহের' ঘটনা ঘটেছে। এইসব তথ্য কীভাবে, কোথা থেকে এল, তার কোন উল্লেখ নেই। ভারতবাসীর তরফে কোন প্রতিবাদ নেই দেখে, মিশনারীরা আরো এককাঠি এগিয়ে বলতে লাগল, ৮-১০ বছরের বিধবা মেয়েদের নাকি জ্বলন্ত চিতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হত। সেই সময়ের সরকারি নথি বলছে যতজন বিধবা সহমরণে যেত, তাদের ৬০% মহিলা চল্লিশোর্ধ্ব। 


মিশনারীদের বাড়াবাড়িতে, বাধ্য হয়ে ১৮১৫ থেকে ১৮২৪ সাল জুড়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার, বাঙ্গালা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীগুলোতে একটা সমীক্ষা চালায়। তাতে জানা যায়, ৬৬৩২ টি 'সতীদাহ'র ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু, ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা তাদের পত্রিকায় (Missionery Register, Missionery Papers) নানারকম মনগড়া পরিসংখ্যান, সাথে রোমাঞ্চকর কাহিনী দিয়ে যেতেই লাগল।


উইলিয়াম ওয়ার্ড (William Ward) লিখলেন , 'সতীদাহ'তে একজন মৃত পুরুষ মানুষের সাথে কোথাও কোথাও ১২ জন, কোথাও ১৩ জন, কোথাও ১৮ জন, তো আবার কোথাও ৩৭ জন বিধবা সহমরণে গিয়েছে। কোন প্রমাণ নেই, কেবল বিবৃতি। ক্লডিয়াস বিউকানন (Claudius Buchanan) বিবৃতি দিলেন, এক কুলীন ব্রাহ্মণের ১০০জন স্ত্রী ছিল, তাদের মধ্যে ২২জনই, স্বামীর সাথে চিতায় উঠে বসেছিল। এখানেও কোন প্রমাণ নেই, কেবল বিবৃতি। তখনকার সরকারি নথি বলছে, ৪টি ক্ষেত্রে ৩জন, ৩টি ক্ষেত্রে ৪জন বিধবা একসাথে  আত্মাহুতি দিয়েছিল। 


'সতীদাহ' বন্ধের আইন হয়েছিল, ভাল হয়েছিল। একটাও বা সহমরণ হবে কেন? সে'টা কথা নয়। ব্রিটিশদের কাজের উদ্দেশ্য মহৎ ছিলনা। 'শ্রীরামপুরের ত্রয়ী' বলে খ্যাত হয়েছিলেন তিন ব্যাপটিস্ট মিশনারী -- উইলিয়াম কেরী (William Carey), উইলিয়াম ওয়ার্ড (William Ward) এবং জশুয়া মার্শম্যান (Joshua Marshman)। এরা ভারতবর্ষ ও হিন্দুদের বদনাম করার কাজে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। এরাই নানারকম মনগড়া তথ্য দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য  একটাই -- ভারতবর্ষে আসা এবং ভারতবাসীদের খ্রীষ্টান করা।


তথ্যসূত্র :

১. 'Sati' (by Dr. Meenakshi Jain)

২. 'Early Sanskritization. Origins and Development of the Kuru State  (by Michael Witzel)

৩. 'The Sati Strategy. Review of Meenakshi Jain’s book Sati' (by Koenraad Elst) 

৪. 'Samaritans Suicide Statistics Report 2017'

৫. Report from Pew Research Center.

৬. Report from Everytown Research and Policy.

৭. 'Position of Women in Hindu Civilization' (by A.S. Altekar)

৮. 'Sati in Modern India: A Report' (by Sangari and S. Vaid, Economic and Political Weekly)


Source: Srabanti Jana 

Popular posts from this blog

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? কেন আমরা ব