Skip to main content

স্বাধীনতার নায়করা পর্ব ~ ১১

কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার এর নাম তো জানেন। কিন্তু জানেন কি যে কে ছিলেন এই সন্তোষ মিত্র..?


ইংরেজদের গণহত্যায় মৃতদের মরদেহ আনতে হিজলী এসেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। বন্দিদের উপর গুলি চালানো এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই কলকাতা কর্পোরেশন তরফে সেন্ট জেমস স্কোয়ার-এর নাম বদলে নাম রাখা হয় 'সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার'। তখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু, তিনিই ছিলেন এই নামবদলের প্রধান কান্ডারি।


আজকের এই পার্ক সংলগ্ন ১সি হলধর বর্ধন লেনের বাড়িতে জন্ম হয়েছিল সন্তোষ মিত্রের। সেখানে এক স্মারক বানানো হয়েছে তাঁর স্মৃতিতে। কলকাতা কর্পোরেশন ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার' এর ভিতরে তাঁর একটি মর্মর মূর্তিও স্থাপন করেছে।


উত্তর কলকাতার এই সন্তোষ মিত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী। ১৯০০ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতায়, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তোষ মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৫ সালে কলকাতায় হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (প্রেসিডেন্সি কলেজ) থেকে দর্শন শাস্ত্রে সাম্মানিক স্নাতক হয়েছিলেন। সন্তোষ মিত্র ছিলেন মেধাবী ছাত্র, এরপরে ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হন। তিনি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ভারতে তখন গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। অত্যাচারী ইংরেজকে দেশছাড়া করতে বাংলার প্রত্যেক যুবক তখন প্রায় বদ্ধপরিকর। সেই সংকল্পে সামিল হয়েছিলেন যুবক সন্তোষ কুমার মিত্র।


উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে সরিয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীন করতে। কলেজ পাশ করার পর দুইয়ের দশকে বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি হুগলি বিদ্যামন্দিরে বিপ্লবী কাজের জন্যে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। হুগলি বিদ্যামন্দিরের প্রধান ছিলেন, বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার। তাঁর মাধ্যমেই সন্তোষ মিত্রের সঙ্গে বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষ এবং যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের পরিচয় হয়। ১৯২২ সালে গড়ে তোলেন স্বরাজ সেবক সঙ্ঘ। গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তিনি এক সময়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রভাবিত হন সশস্ত্র বিপ্লব মতাদর্শে। শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের সময় অস্ত্র সাহায্য করতেন গোপনে। অহিংস আন্দোলনের সময় কারাবাসও করেছিলেন, ফলে চট করে ব্রিটিশদের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন।


১৯২৩ সালে 'শাঁখারীটোলা হত্যা মামলায়'; এক ইংরেজ পোস্ট মাস্টারকে খুনের অভিযোগে, সন্দেহের বশে তাঁকে গ্রেফতার করা। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান সন্তোষ মিত্র। বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলাতেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এবারেও প্রমাণ ছিল না, ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন যান। সন্তোষ কুমার মিত্র ক্রমেই, ইংরেজদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইংরেজ সরকার 'বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট' প্রয়োগ করে, দেশের নিরাপত্তার জন্যে তাঁকে বিপদজনক ঘোষণা করে। এই আইন অনুযায়ী, বিনা বিচারে যেকোনো মানুষকে আটকে রাখা যায়। ফলে সন্তোষ মিত্র হয়ে গিয়েছিলেন, 'সিকিউরিটি প্রিজনার'


তখন প্রচুর সংখ্যক মানুষকে বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে রাখা হতো, ফলে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করে রাখার কারণে, শাসকের সামনে এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আলিপুর ও অন্য কারাবাসগুলোতে সাধারণত দাগি আসামিদের সঙ্গেই এঁদের রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, এই বন্দিদের যেহেতু কোনও পূর্ব অপরাধের অভিযোগ ছিল না; তাই সমাজে ও জনমানসে এই বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। "সিকিউরিটি প্রিজনার" রাখার জন্যে ১৯৩১ সালে ইংরেজ সরকার আলাদা তিনটি ডিটেনশন ক্যাম্প, তৈরি করে। বহরমপুর, বক্সাদুয়ার এবং খড়গপুর রেল জংশনের কাছে হিজলীতে তৈরি হয়েছিল তিনটি ক্যাম্প।


হিজলীতে সন্তোষ মিত্রকে রাখা হয়েছিল। এই বিশেষ বন্দিদের কিছু স্বাধীনতা থাকলেও, যদিও বাইরের রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের কোনো অধিকার ছিল না। ওই বছর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চরমে পৌঁছায়, বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির সাজা ঘোষণাকারী বিচারক রেনোল্ড গার্লিককেও ২৭শে জুলাই আলিপুরে কোর্টের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার খবর বেশ কিছুদিন পর হিজলী ক্যাম্পে পৌঁছয়। বন্দিদের মধ্যে উৎসব ও জয়ের উন্মাদনা দেখা যায়। ফলে শাসকদের সমস্ত রাগ গিয়ে পরে হিজলীর বন্দিদের উপর। ১৫ই সেপ্টেম্বর হিজলী জেল থেকে তিন বিপ্লবী বন্দি সফল ভাবে পালাতে সক্ষম হন।


ফলত পরিস্থিতি সামলাতে ১৬ই সেপ্টেম্বর বিশাল পুলিশ বাহিনী দিয়ে হিজলী ক্যাম্প ঘিরে ফেলা হয়। চলে তল্লাশি। কিন্তু কেবল তল্লাশিতে থেমে থাকেনি ইংরেজরা। এক বর্বরোচিত নরকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা। বিনা আদেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। মোট ২৯ রাউন্ড গুলি চলে। ২৫ জন বন্দি গুরুতর আহত হন। মারা যান তিনজন বন্দি। মৃতদের তালিকায় ছিলেন বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র। শহিদ হন সন্তোষ মিত্র। ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ চন্দ্র বোস ছুটে গিয়েছিলেন হিজলিতে।


আজ দুর্গা পুজোর আড়ম্বরের আড়ালেই থেকে যায় লেবুতলা পার্কের তাঁর শহিদবেদি। এটা লজ্জার যে আমরা সবাই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারকে চিনি দুর্গাপুজোর নামে, কিন্তু সন্তোষ মিত্রকেই চিনি না..!

পারলে ক্ষমা করবেন আমাদের...

সন্তোষ মিত্র


Popular posts from this blog

দাড়িভিটের স্ফুলিঙ্গ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রদীপ জ্বালাতে আমরা ব্যর্থ

এসো হে সেপ্টেম্বর, আমার ভাষার মাস। ভাষাতীর্থ দাড়িভিট, রাজেশ তাপসের বাস।। ২০১৮-র ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার দাড়িভিট হাইস্কুলের গুলি চালনার ঘটনা এখন সবাই জানেন। আলোচনার সুবিধার জন্য অল্পকথায় প্রেক্ষাপটটা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক। দাড়িভিট হাইস্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ছিল বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের। এই স্কুলে উর্দুভাষী ছাত্র-ছাত্রী নেই। স্থানীয়রা মুসলমান। তৃণমূল নেতার তৎপরতায় সরকারের বিদ্যালয় দপ্তর পাঠালো বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের জায়গায় উর্দু শিক্ষক এবং সংস্কৃত শিক্ষক। অবাঞ্ছিত উর্দু শিক্ষকের নিয়োগকে একটু সহনশীল করার জন্য সম্ভবত সংস্কৃত শিক্ষককের নামটাও যুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্ররা মানেনি, প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীরা। অতএব পুলিশ সামান্য উত্তেজনাতেই গুলি চালায়, ফলে দুই প্রাক্তন ছাত্র রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মণের মৃত্যু হয়। এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তাহখানেক উত্তাল হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন এবিভিপি মিছিল মিটিং করে। বিজেপি ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বন ডাকে যা আংশিক সফল হয়। এই বনধকে সফল করতে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির যুবমোর্চার সভাপতি দেবজিৎ সরকার দাড়িভিট গেল...

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? ক...