Skip to main content

স্বাধীনতার নায়করা পর্ব ~ ৮

আমরা সবাই বর্তমান সময়ে কলকাতায় অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সি. আই. ডি. ডিপার্টমেন্টের অন্যতম হেডকোয়ার্টার ভবানী ভবনের নাম জানি। কিন্তু কার নামে নামাঙ্কিত হয়েছে এই হেডকোয়ার্টার? কি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান? আজ সেই মহান বিপ্লবীর কথাই বলবো..


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক গঠিত বি. ডি. বা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের কথা বলে শেষ করা যায় না। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনকে সামনে রেখে তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব সুভাষচন্দ্র বসুকে জি. ও. সি. ঘোষনা করে যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি করে, পরবর্তীকালে সেই সংগঠনই হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ বিপ্লবী সংগঠন বেঙ্গল। ভলেন্টিয়ার্স। তাবড় তাবড় বিপ্লবী নেতাদের নেতৃত্বে এবং ক্ষুরধার পরিকল্পনায় ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো বি.ভি.-র বিপ্লবীরা। বিনয়-বাদল-দীনেশ, যতীন দাস, উপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়, হেমচন্দ্র ঘোষ থেকে শুরু করে বি. ভি.-র বিপ্লবীদের কথা বলে শেষ করা যায় না। এই বি.ভি-র ই একজন অকুতোভয়, তরুণ বিপ্লবী ছিলেন শহীদ ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্য (ডাকনাম টুনা); যাঁর নামে আজকের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সি. আই. ডি. বিভাগের হেডকোয়ার্টারের নাম নামাঙ্কিত হয়েছে “ভবানী ভবন"।


ভবানীপ্রসাদের জন্ম হয় ১৯১৪ সালের ১০ই জুন, বরিশাল জেলার বাঁদরি গ্রামে। পিতার নাম বসন্ত ভট্টাচার্য। মাতা দময়ন্তী দেবী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী, প্রতিবাদী, অথচ ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের। রীতিমতো শরীর চর্চা করতেন। গ্রামের কারো কোনো বিপদ হলেই এগিয়ে আসতেন ভবানী। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য তাঁর পিসতুতো ভাই ছিলেন। ভাওয়ালের রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায় (সন্ন্যাসী রাজা)। তরুণ বয়সে সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সে যোগদান করেন। ভারতে তখন ব্রিটিশ অত্যাচার চরমে উঠেছে। তবে বিপ্লবীরাও চুপ করে বসে ছিলেন না মারের বদলা পাল্টা মার' নীতি নিয়ে তাঁরাও ব্রিটিশ শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিতে লাগলেন।


মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ছিল ব্রিটিশদের উপর এক চরম আঘাত। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয় ১২ই জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে। ব্রিটিশ ভেবেছিল পীড়ন চালিয়ে আর বিপ্লবীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাংলার বিপ্লবীদের দমন করা যাবে। কিন্তু তাদের এই নীতিকে অগ্রাহ্য করে বাংলার বিপ্লবীরা একের পর এক আঘাত হেনে যেতে লাগলেন। ফাঁসির মঞ্চ ও দড়ি চুম্বন করে দেশমাতৃকার জন্য হাসিমুখে শ‍হীদ হয়ে এই দামালরাই ব্রিটিশ শাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি নথি থেকে জানা যায় কেবলমাত্র বাংলাতেই ৪১ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। তবে ব্রিটিশ বুঝতে পেরেছিল বাংলার বিপ্লবীদের রক্তে সর্বনাশের নেশা লেগেছে তোমায় মেরে আমি মরব'। এদের দমন করা সহজ নয় ।


ব্রিটিশ অফিসার জন এন্ডারসন অ্যায়ারল্যান্ডে থাকাকালীন সেখানকার বিপ্লবীদের উপর অকথা দমন-পীড়ন চালানোর জন্য কুখ্যাত হয়েছিল। বাংলায় বাড়তে থাকা বৈপ্লবিক কার্যকলাপে ভীত এবং সন্ত্রস্ত ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে বাংলার দায়িত্ব তুলে দেয় এই এন্ডারসনেরই হাতে। অ্যায়ারল্যান্ডের মতো বাংলাদেশে এসেও এন্ডারসন একই রকম দমন-পীড়ন নীতি চালু করে। এই একই সময় বি. ভি.-র অন্যতম নেতা যতীশ গুহ ব্রিটিশ কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অত্যাচারী অ্যান্ডারসনকে চিরকালের মতো পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চার জন তরুণ বিপ্লবী সাথে তিনি একটি গোপন বৈঠক করেন। এই চারজন বিপ্লবীরা হলেন ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্য, রবিরঞ্জন ব্যানার্জি, মনোরঞ্জন ব্যানার্জি এবং উজ্জ্বল মজুমদার। এই চারজনকে একটাই নির্দেশ দেওয়া হয় - "অত্যাচারী অ্যান্ডারসনকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে তোমাদের"।


পরিকল্পনা মতো চারজন এসে উপস্থিত হলেন দার্জিলিং-এ এন্ডারসনের তখন দার্জিলিং-এর লেবং-এর রেসকোর্সের এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। দিনটা ছিল ৮ই মে ১৯৩৪। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ওই চারজন বিপ্লবী সাহেবী পোষাকে সজ্জিত । হয়ে, দুটি দলে বিভক্ত হয়। টিকিট কেটে সাধারণ দর্শকের আসনে বসলেন তাঁরা। সাথে নিলেন একটা হারমোনিয়াম। কারণ ওই হারমোনিয়ামের মধ্যেই ছিল পিস্তল। এন্ডারসনকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও মিলিটারি, একটা মাছি গলবারও জো নেই।


ভবানীপ্রসাদ, রবিরঞ্জনকে বললেন “যে ভাবে অ্যান্ডারসনকে পুলিশ, মিলিটারি ঘিরে রেখেছে একবারই গুলি করার সুযোগ পাবো। প্রথমে আমি গুলি চালাচ্ছি, তুই অন্য দিক থেকে গুলি কর।" ভবানীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। এন্ডারসন তার মহিলা স্টেনোগ্রাফারের পেছনে লুকিয়ে পরলো। ফলস্বরূপ গুলিবিদ্ধ হলেন সেই মহিলা স্টোনোগ্রাফার। এদিকে এন্ডারসনের দেহরক্ষী বাহিনীর গুলির আঘাতে আহত হলেন ভবানীপ্রসাদ। আহত ভবানীপ্রসাদ এবং রবিরঞ্জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। সেই সাথে ধরা পড়লেন অন্য দু'জন বিপ্লবী মনোরঞ্জন ব্যানার্জি এবং উজ্জ্বল মজুমদারও। বিচারের দুটি ধারায় ভবানীপ্রসাদ এবং রবিরঞ্জনকে মৃত্যুদণ্ড দিল আদালত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল মনোরঞ্জনকেও। তবে উজ্জলকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। পরে আদালত রবিরঞ্জন এবং মনোরঞ্জনের মৃত্যুদণ্ড তুলে নিয়ে তাঁদেরও যাবজ্জীবন দেয় ভবানীপ্রসাদকে ব্রিটিশ সরকার বলেছিল "তুমি যদি ভুল স্বীকার করো, তবে তোমার মৃত্যুদণ্ড না হয়ে কম শাস্তি হবে।”


উত্তরে এই অকুতোভয়, তরুণ বিপ্লবী বলেন "সুযোগ পেলে ভারতমাতার সম্মান লুন্ঠনকারী, অত্যাচারী এন্ডারসনকে গুলি করে মারব।" এরপর ১৯৩৫ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার কেন্দ্রীয় কারাগারে 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনী দিয়ে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে শহীদ হলেন ভারত মাতার এই বীর সন্তান।


তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের হাতে তাঁর দেহ জেল কর্তৃপক্ষ তুলে দিতে চাইলে ভবানীপ্রসাদের মা দময়ন্তী দেবী ব্রিটিশকে বলেছিলেন- "ভবানী প্রসাদ শুধু আমারই সন্তান নয়,ভারত মাতার সন্তান। কাজেই ভবানী প্রসাদকে আমার হাতে ফেরত দিতে হবে না। ভারতবাসীই তাঁর সৎকার করবে।”


শহীদ ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্যের আগে অত্যাচারী এন্ডারসনের নামে ভবানী ভবনের নাম ছিল 'এন্ডারসন হাউস'। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদের পরিবারের আবেদনে ১৯৬৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ভবানী ভবন রাখা হয়। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে যাঁর নাম ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম বসু, মঙ্গল পান্ডের সাথে একসাথে উচ্চারিত হওয়ার কথা আজ তিনি স্মৃতির অন্তরালে। অনেকেই জানেনা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া এই শহীদের ইতিহাস..

ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য (টুনা)


সংকলনে : অর্নব বন্দোপাধ্যায়

তথ্যসূত্রঃ আমি সুভাষ বলছি (শ্রী শৈলেশ দে), শ্রী ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্যের আত্মীয় শ্রী ফাল্গুনী ঘোষাল মহাশয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী

জয়হিন্দ| বন্দেমাতরম|

© এক যে ছিলো নেতা


Popular posts from this blog

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? কেন আমরা ব

ছেলেরা কেন দিনদিন 'বৌদিবাজ' হয়ে উঠছে?

সমাজটা খুবই খারাপ দিকে যাচ্ছে। ছেলেরা এখন বৌদিবাজ হয়ে উঠেছে! তারা একবার করে প্রেমে ছেঁকা খাওয়ার পর আর অন্য কোনও প্রেমিকা জোটায় না, বৌদিদের সাথে গল্প করে। কারণ - ১| ধোঁকা খায় না ২| হৃদয়ে আঘাত লাগে না ৩| Break up 💔 বলে কিছু থাকে না ৪| অনেকটা Stunt বাজীর মতো, মাথায় কোনো চাপ নেয়ার দরকার পরে না  আর একটা বিষয় হলো এখন বেশিরভাগ ছেলে পড়াশোনা দিকে ব্যস্ত। তাই তাদের হাতেও বেশি সময় থাকে না। আবার বৌদিদের হাতেও বেশি সময় সীমিত। তাই একটা Understanding বজায় থাকে। আরেকটা জিনিস হল নতুন প্রেমিকারা যেরকম নানারকম চাপ দেয়। বৌদীরা অনেকটা বোঝে ব্যাপারগুলো। যেমন- ফাঁকা পকেট, কম সময়, Relation Public না করা... এসব জিনিস। সেই কারণে তারা এতটা চাপ দেয় না। অল্পবয়সী মেয়ের একটু জেদি হয়। তাই তারা অকারণেই ঝগড়া করে যা এমনিতেই চাকরি আর ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত ছেলেদের ভালো লাগে না। তাই তারা বৌদিদের দিকেই ঝোঁকে। বিয়ে তো অবশ্য ভালো কোনো মেয়ে দেখেই করবে, তার আগের সময়টা অন্য দিকে দেয় - বৌদিদের সাথে আড্ডা মারে। বৌদিদের সাথে কথা বলে আর কিছু হোক বা না হোক মানসিক শান্তি আছে। আমার বৌদিবাজ বন্ধুদের জন্য 💖

রাষ্ট্রভক্ত বীরাঙ্গনা হীরা দে

 🌹💥🕉️ দুর্নীতিবাজদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তার উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে জানা যায়। এই শাস্তিও কোন রাজা বা সরকার দিয়েছিল না দিয়ে ছিল শুধুমাত্র তার পরিবারের সদস্যরা। 💢 1311 খ্রিস্টাব্দে, আলাউদ্দিন খিলজিকে জলোর দুর্গের গোপন কথা বলার জন্য পুরস্কার হিসাবে পাওয়া অর্থ নিয়ে ভিকা দাহিয়া আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন।এত টাকা এই প্রথম দেখল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল যুদ্ধ শেষ হলে এই টাকা দিয়ে একটা বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি করে আরামে বসবাস করবে।প্রাসাদের সামনে ঘোড়া বাঁধা থাকবে, চাকর থাকবে।  তার স্ত্রী হীরা স্বর্ণ ও রৌপ্য গয়না দ্বারা সারা শরীর ঢাকা থাকবে। আলাউদ্দিন কর্তৃক জালোর কেল্লায় নিযুক্ত সুবেদারের দরবারে তিনি বড় মর্যাদার বিবেচিত হবেন।বাড়িতে পৌঁছে বিড়বিড় করে হেসে টাকার বান্ডিলটা বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী হীরা দে'র হাতে।  🌹স্বামীর হাতে এত টাকা এবং স্বামীর মুখ ও অভিব্যক্তি দেখে হীরাদে আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যদের দিল্লি ফিরে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে জালোরের যুদ্ধে হতাশ হয়ে হঠাৎ জালোরের দিকে ফিরে যায়। হীরা দে বুঝতে পেরেছিলেন যে তার স্বামী ভিকা দাহিয়া তার জন্মভূমি জ