Skip to main content

স্বাধীনতার নায়করা পর্ব ~ ১২

 ||গুমনাম বিপ্লবী ||


সেদিন ছিলো ২৭শে জুলাই ১৯৩১.. সকাল দশটা নাগাদ একটা কালো অস্টিন গাড়ি ঢুকলো আলিপুর কোর্ট চত্বরে। সামনে বসা দেহরক্ষী নেমে দরজা খুলে দিতে ধীর পায়ে নামলেন বিচারপতি গার্লিক। কদিন আগেই রাইটার্স বিল্ডিং অলিন্দ যুদ্ধের নায়ক বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। তার আগে আরো এক কিশোর চট্টগ্রামের রামকৃষ্ণ বিশ্বাস কেও পাঠিয়েছেন ভবপারে।


বড়লাটের অভিনন্দন পেয়ে সকাল থেকেই মনটা খুশি খুশি। গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে পা দিলেন আদালতের সিঁড়িতে। দু তিন ধাপ উঠেছেন অমনি ওপরের থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক রোগাটে কিশোর। বিস্ময়ে হতবাক জজসাহেব দেখেন সে দুহাতে পিস্তল উঁচিয়ে তাক করেছে তারই দিকে। চীৎকার করার আগেই পরপর পাঁচটা গুলি ফুঁড়ে দিল তাকে। বিচারকের


সম্পন্ন হলো শেষ বিচার! ততক্ষণে দেহরক্ষীও গুলি চালিয়েছে। আহত হয়েও কিশোর পকেট থেকে সায়ানাইড ক্যাপসুল বের করে মুখে দিল আর ঢলে পড়লো সিঁড়ির ওপর।


কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত টেগার্ট সহ কলকাতা পুলিশের বাঘা গোয়েন্দারা, তল্লাশি চালিয়ে কিশোরের পকেট থেকে পাওয়া গেল একটা নোটবুক। তাতে লেখা, "Get destroyed, get the award for hanging Dinesh Gupta." নীচে সই বিমল দাশগুপ্ত।


তবে এই কি সেই বিমল যাকে মেদিনীপুরের জেলা শাসক পেডি হত্যার জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে? বিনয়-বাদল-দীনেশ-এর কথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু বিস্মৃতির পলিতে ঢাকা পড়েছেন অগ্নিযুগের এই বলিপ্রদত্ত বিপ্লবী। তাঁর প্রসঙ্গে যেতে হলে আগে বলতে হবে রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ যুদ্ধের কথা।


📆৮ই ডিসেম্বর,১৯৩০📆


রাইটার্সে ঢুকলেন বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত, তিনজনের পরনেই সাহেবী পোশাক। গেটের রক্ষীরা বুঝতেই পারল না ছদ্মবেশ। সেদিন তাঁদের নিশানায় ছিল ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন। বিপ্লবী, স্বদেশীদের উপর নির্মম অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত ছিলেন ইংরেজ তনয়। সরাসরি গুলি করে তাঁকে হত্যা করেন বিনয়-বাদল- দীনেশ।


নিমেষের মধ্যে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, তারপর শুরু হলো রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই। একদিকে বিনয়-বাদল- দীনেশ, অন্যদিকে টেগার্টের নেতৃত্বে সশস্ত্র গোর্খা বাহিনী।


ধরা দেবেন না বলে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মঘাতী হন বাদল। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের মাথায় গুলি করেন। পাঁচ দিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় বিনয়ের। ভয়াবহ আহত হলেও প্রাণে রক্ষা পান দীনেশ। তাঁকে ১৯৩১-এর ৭ জুলাই ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি 'গার্লিক'।


এর ঠিক বিশ দিন পরে, ২৭ জুলাই আলিপুর আদালতের মধ্যেই বিচারপতি গার্লিককে গুলি করে হত্যা করেন এক কিশোর বিপ্লবী। ব্রিটিশদের হাতে ধরা দেবেন না, পণ করেছিলেন বছর বাইশের এই তরুণ। গার্লিক লুটিয়ে পড়লে, আগে নিশ্চিত হন তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা তারপর 'বন্দেমাতরম' বলে মুখে ঢেলে দেন পটাশিয়াম সায়ানাইড।


পুলিশ যখন উদ্ধার করল বিপ্লবীর দেহ, তার পকেটে পাওয়া গেল একটা চিরকুট তাতে সই বিমল দাশগুপ্ত, যিনি হত্যা করেছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডি সাহেবকে।


আদতে কিশোর ছিল ২৪ পরগণা জেলার মজিলপুরের কানাইলাল ভট্টাচার্য। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান স্কুলে থাকতেই বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসে এবং যোগ দেয় বিভি বা ' Bengal volunteers'-এ। দীনেশ গুপ্তর ফাঁসি হবার পর দলের নির্দেশে গারলিক হত্যার দায়িত্ব নেয়। ইচ্ছে করেই পকেটে বিমলের নাম রেখেছিলেন যাতে পুলিশ তাকে খোঁজা বন্ধ করে দেয়।


বহুদিন পর্যন্ত পুলিশের ধারণা ছিল এই কিশোর ই বিমল, এমনকি যখন পুলিশ কানাইয়ের মাকে ডেকে তার দেহ দেখায়, তিনিও তার ছেলে নয় বলে স্বীকারোক্তি দেন..!! সম্ভবত স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ইনি একমাত্র বিপ্লবী যিনি এক ইংরেজ শাসককে হত্যার কৃতিত্বের চেয়ে সহযোদ্ধার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।


আজ যখন মানুষ আত্মপ্রচারের জন্য পাগল, নেতারা শৌচাগার উদ্বোধন করলেও টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন বড় বেশী করে মনে পড়ে কানাইদের কথা। 


দেশের স্বার্থে, বিপ্লবের জন্য নাম-যশ-খ্যাতি কোনও কিছুর পরোয়া করতেন না কানাইলাল ভট্টাচার্যর মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গরা। তাঁর স্মৃতিতে আলিপুর বেকার রোডের নামকরণ করা হয়েছে বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য রোড। জন্মস্থান মজিলপুরের একটি রাস্তাও তাঁর নামে নামাঙ্কিত। পৈতৃক বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রোঞ্জ মূর্তি।

অবশ্য, দেশমাতৃকার মুক্তি ছাড়া এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ছিল কানাইলালদের?

কানাইলাল ভট্টাচার্য

জয়হিন্দ|বন্দেমাতরম|

কলমে - স্বপন সেন


© এক যে ছিলো নেতা


Popular posts from this blog

দাড়িভিটের স্ফুলিঙ্গ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রদীপ জ্বালাতে আমরা ব্যর্থ

এসো হে সেপ্টেম্বর, আমার ভাষার মাস। ভাষাতীর্থ দাড়িভিট, রাজেশ তাপসের বাস।। ২০১৮-র ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার দাড়িভিট হাইস্কুলের গুলি চালনার ঘটনা এখন সবাই জানেন। আলোচনার সুবিধার জন্য অল্পকথায় প্রেক্ষাপটটা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক। দাড়িভিট হাইস্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ছিল বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের। এই স্কুলে উর্দুভাষী ছাত্র-ছাত্রী নেই। স্থানীয়রা মুসলমান। তৃণমূল নেতার তৎপরতায় সরকারের বিদ্যালয় দপ্তর পাঠালো বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের জায়গায় উর্দু শিক্ষক এবং সংস্কৃত শিক্ষক। অবাঞ্ছিত উর্দু শিক্ষকের নিয়োগকে একটু সহনশীল করার জন্য সম্ভবত সংস্কৃত শিক্ষককের নামটাও যুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্ররা মানেনি, প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীরা। অতএব পুলিশ সামান্য উত্তেজনাতেই গুলি চালায়, ফলে দুই প্রাক্তন ছাত্র রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মণের মৃত্যু হয়। এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তাহখানেক উত্তাল হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন এবিভিপি মিছিল মিটিং করে। বিজেপি ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বন ডাকে যা আংশিক সফল হয়। এই বনধকে সফল করতে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির যুবমোর্চার সভাপতি দেবজিৎ সরকার দাড়িভিট গেল...

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? ক...