Skip to main content

স্বাধীনতার নায়করা পর্ব ~ ১

চন্দননগর মহাশ্মশান... সেখানে এক বিপ্লবীর স্মৃতিফলক আজও রয়েছে, উপরে লেখা চট্টগ্রাম অস্ত্রগার দখলের মহান বিপ্লবী জীবন ঘোষালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্থাপিত এই ফলক... কিন্তু কে এই জীবন ঘোষাল? আর কর্ণফুলীর পাড় থেকে গঙ্গাতীরেই বা কেন এসেছিলেন তিনি?


দিনটা ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০

চট্টগ্রামের কাছাকাছি ধুম রেলস্টেশনে হঠাৎ করে লাইনচ্যুত হয়ে যায় একটি মালবাহী ট্রেন। কারা যেন রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে রেখেছিল। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাথে পুরো দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই একই রাতে অন্য একটি দল হামলা চালায় চট্টগ্রামের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসে। সব যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দিয়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেয় ভবনটিতে। ফলে এবার সম্পূর্ণরূপে বিকল হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। চট্টগ্রামে সেদিন রচিত হয়েছিল এক অসীম সাহসিকতার উপাখ্যান।


হঠাৎ দুর্ঘটনার শিকার হলেন এ কাজের দায়িত্বে থাকা হিমাংশু সেন। ভবনে পেট্রোল ঢালার সময় কখন যে তার কাপড় আর গায়েও পেট্রোল ছিটকে পড়েছিল টেরই পাননি। আগুন লাগানোর সাথে সাথে জ্বলে উঠে তার শরীরেও। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করেন হিমাংশু সেন। হিমাংশুর অবস্থা দেখে কোনোরকম পরামর্শ না নিয়েই প্রধান দুই সেনানায়ক গনেশ ঘোষ আর অনন্ত সিংহ তাকে মোটরগাড়িতে তুলে ছুটে যান শহরের দিকে। সাথে যান আনন্দ গুপ্ত ও জীবন ঘোষাল। কিন্তু দুর্ভাগ্য! এই যে তারা বিচ্ছিন্ন হলেন, শত চেষ্টা করেও আর মিলিত হতে পারেননি মূল দলের সাথে।  


অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাদের দেরী দেখে বিপ্লবীদের মনে সংশয় দানা বাঁধতে থাকে। তবে কি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে আবার সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গেছে ? এরা চারজন কি তবে ধরা পড়লেন? এসব সংশয়ে পড়ে তারা আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত নেন। সামরিক বাহিনী যেকোনো সময় ঘিরে ধরতে পারে এই ভেবে ছাড়েন পুলিশ লাইনও। তারা পিছু হটতে থাকেন জালালাবাদ পাহাড়ের দিকে।


২২শে এপ্রিল, ১৯৩০

জালালাবাদ যুদ্ধ শেষ। এগারোটি শহীদের চিতার আগুন চট্টগ্রামের আকাশে রক্তের আখরে লিখে দিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ জিন্দাবাদ! কিন্তু অন্যতম নায়করা তখন কোথায়? না কোন খবর আছে গণেশ ঘোষ বা অনন্ত সিংহের, না আনন্দ গুপ্ত ও জীবন ঘোষালের। আহত হিমাংশু কে নিয়ে সেই যে ১৮ তারিখে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই।


খবর পাওয়া গেল সেদিন রাত আটটায়, চট্টগ্রাম থেকে আট মাইল দূরে পুটিয়ারী রেল স্টেশনে। কাউন্টারে এক সুদর্শন কিশোরকে দেখে কেমন যেন সন্দেহ হলো স্টেশন মাস্টার অশ্বিনী ঘোষের। যদিও গ্রাম্য চেহারা কিন্তু পেছনে যে রয়েছে আরো তিনজন। চাটগাঁ তে জোর লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে, তাদের কেউ নয়তো ? লোভে চকচক করে উঠলো ঘোষের পো'র চোখ। ট্রেন ঢুকতেই গার্ড ফেরেরাকে জানালো নিজের সন্দেহের কথা। এখানেই থেমে থাকলো না সে, উদ্যোগ নিয়ে কুমিল্লা, ফেণী আর লাকসাম স্টেশনে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল তার সন্দেহর কথা। এই এই টিকিট নম্বরের চার যাত্রীর ওপর নজর রাখুন।


রাত দুটোয় ফেণী স্টেশনে ঢুকলো গাড়ি। বিশাল পুলিশ বাহিনী প্রতিটি কামরায় শুরু করলো তল্লাশি। প্রথমেই এলো জীবন ঘোষালের পালা। টিকিট চেক করার পরেই হুকুম, দেখি তোমার কোমরে কি আছে ? শুধু বলার অপেক্ষা, নিমেষে অনন্ত সিংহের রিভলবার আগুন ছড়াতে শুরু করলো। সঙ্গত দিলো আনন্দ ও জীবন। গণেশ ঘোষ প্লাটফর্মে নেমেছিলেন, আওয়াজ পেয়ে তিনি বাইরে থেকেই ফায়ার করতে লাগলেন। হতচকিত পুলিশ বাহিনীর চোখের সামনে দিয়ে তাঁরা মিলিয়ে গেলেন রাতের অন্ধকারে।


১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩০

রাত তখন তিনটে। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো পুলিসের বুটের আওয়াজ। চন্দননগর গোন্দলপাড়ার এক বাড়ির পাশে সারি সারি হেলমেট পরা মাথা। পুরো বাড়িটাকেই ঘিরে ফেলেছে তারা। স্বাধীনতা আন্দোলনের যে আগুন জ্বলেছিল চট্টগ্রামে, তারই আরেক অধ্যায়ের সূচনা হলো সেদিন চন্দননগরে।


নানা জায়গা ঘুরে ওই বাড়িতে তখন লুকিয়ে রয়েছেন চট্টগ্রামের পলাতক বিপ্লবীরা আর তাদের আশ্রয়দাতা তথাকথিত এক দাদা- বউদি। যুবকেরা পণ করেছেন তাঁরা আর পালাবেন না। পালাতে পালাতে তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আজ তাঁরা ' হয় মারবেন নয় মরবেন'|


বিপ্লবীরা কিন্তু আগেই খবর পেয়েছিলেন তাঁদের শেষ করতে আসছে ব্রিটিশ পুলিস। বিপ্লবী বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাই সত্যেনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, কে এক কালীপদ ঘোষ বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিসকে তাঁদের ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে। পুলিস কমিশনার টেগার্ট স্বয়ং আসছেন। তাঁরা যেন চন্দননগর ছেড়ে পালিয়ে যান। ফরাসি আইনে রাতে কোনও বাড়ি খানা তল্লাসী করার নিয়ম নেই। বাড়ি ঘিরে তাই সারারাত ওঁত পেতে বসে রইলো টেগার্ট আর তার বিশাল পুলিসবাহিনী।


আর সময় নেই...


বিপ্লবী গণেশ ঘোষ বললেন, পেছনের দরজা দিয়ে রিভলভারের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগুতে হবে। ওঁরা বার হতেই শুরু হল পুলিসের গুলিবৃষ্টি। টর্চের জোরালো আলোয় চারপাশ একদম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। শেষরক্ষা হল না। মাখন ওরফে জীবন ঘোষালের বুকে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগল গুলি। ছিটকে পুকুরের জলে পড়লেন তিনি। সবচেয়ে কমবয়সি আনন্দ গুপ্তের ঊরুতে গুলি লাগায় তিনি তখন মাটিতে ধরাশায়ী। শিগগিরই শেষ হলো এক অসম লড়াই।


শুরু হলো বন্দি বিপ্লবীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন নারী হয়ে রেহাই পেলেন না ছদ্মবেশী বউদিও। আনন্দ গুপ্ত, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, মহিলা আর তাঁর ছদ্ম স্বামীর বেশধারী শশধর আচার্যকে বন্দি করে গাড়িতে তুলল তারা। 


ওদিকে পুকুরের জল থেকে জীবন ঘোষালের মৃতদেহ উদ্ধার করে মেয়রের নেতৃত্বে মিছিল করল চন্দননগরবাসী। সেই স্বনামধন্য মেয়র হলেন চারুচন্দ্র রায়। যাঁর নেতৃত্বে শহরবাসী ফরাসি পুলিসকে মৃতদেহ স্পর্শ করতে দেয়নি। চট্টগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত জীবন ঘোষালের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হল চন্দননগরের মহাশ্মশানে। চট্টগ্রামে সদরঘাটে জন্ম নেয়া এই কিশোরের বয়স তখন মাত্র আঠারো।


সেদিন চট্টগ্রামের এই বিপ্লব হয়তো সম্পূর্ণ সফল হয়নি, কিন্তু গোটা ব্রিটিশ রাজের ভিতকে অবিশ্বাস্য রকমের নাড়া দিয়েছিল। সাহস যুগিয়েছিল আরো অগণিত বিপ্লবীকে, তাদের বিশ্বাস যুগিয়েছিল। চট্টগ্রাম পারলে আমরা কেন নয়! মাস্টারদা সূর্যসেন ও তার দল যখন পেরেছেন পারবো আমরাও। সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের হৃদয়ে আজো তাঁরা বেঁচে আছেন।


বেঁচে আছেন সাহসিকতার প্রতীক হয়ে... বেঁচে আছেন বিপ্লবের প্রতীক হয়ে। যতদিন মুক্তির লড়াই থাকবে, ততদিন জীবন ঘোষালরা বেঁচে থাকবেন মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ের প্রেরণা হয়ে..! 

জয়হিন্দ। বন্দেমাতরম।

✍কলমে : স্বপন সেন



© এক যে ছিলো নেতা

Popular posts from this blog

 বর্তমানে রাত্রীকালীন বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা :- ____________________________________ মুসলমান অত্যাচারের কারণে 'রাত্রি কালীন গোপন বিবাহ' রীতির প্রচলন। এসব সত্য জানার সত্ত্বেও এখনও এই রীতি বয়ে নিয়ে হচ্ছে। তার সম্ভাব্য কারণ কি কি হতে পারে? ১| দিনের বেলা সকলে ব্যস্ত থাকে নানা কাজে। কেও স্কুলে, কেও অফিসে কেও বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকেন। তাই সেই কাজের মাঝে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই সন্ধ্যার লগ্নে বিয়ে হলে মানুষ দুপুরে কাজের শেষে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যেয় সেজেগুজে এসে বিয়ে দেখতে পারে। রাত্রে প্রায় সকলেই বাড়িতে থাকেন। তাই কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করা বিষয়টা অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাট মনে হয়। ২| এখন বিবাহ একটি পারিবারিক উৎসব নয়। বরং বিবাহ আত্ম অহংকার, ক্ষমতার প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। রাতে জমকালো Light Show দেখানো যায়। বাজীর প্রদর্শনী করা যায়। এর সাথে আরও যত রকমভাবে নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন করা সম্ভব সবরকম চেষ্টাই করা হয়। কিন্ত দিনে এই সমস্ত ঘটনার Prime Focus একজনের উপর পড়া সম্ভব নয়, তাই রাত্রে। ৩| সামাজিক দৃষ্টিকোণ: বর্তমানে দিনে বিবাহ দেওয়াকে দারিদ্রতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ...

ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার তত্ত্বের Propaganda Vs Reality

ভারত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলে প্রায় 50 কোটি মুসলিম বাস করে। কিন্তু, এতো মুসলিম তো আরবেও নেই। তাহলে এতো মুসলমান এলো কোথা থেকে? অন্য ধর্মের লোক এতো দ্রুত হারে বাড়ছে না কেনো? অন্য ধর্মের 50 কোটি লোক হলোনা কেনো ? Communist আর secular দের বক্তব্য এরা হিন্দুই ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে আর মুসলিমদের ধর্মের উদারতার কারণে জাত-পাতহীনতার কারণে এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এরা মুসলিমদের দান-ধ্যানের নীতি, সুফি_সন্তদের জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়ে "ইসলাম" ধর্ম গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার তত্ত্ব  Communist রা হিন্দু সমাজকে দুইভাগে ভাগ করেন-- 1. উচ্চ বর্ণ  2. নিম্ন বর্ণ সমাজের সবচেয়ে ভক্তিবান মানুষ হলো তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষরা। তাদের কাছে ধর্মই সব। তাঁরা সব করতে পারেন কিন্তু ঠাকুর কে অবহেলা করেন না। তাঁরা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের জন্যেই ধর্মান্তরিত হয়েছে এটা বিশ্বাস করেন কিভাবে❓ এটা তো গেলো পুরোনো যুগের কথা.... এবার এখনকার কথা বলি.... আচ্ছা বলুন তো, আমরা আমাদের পারিবারিক সূত্রে বা বন্ধুদের সূত্রে প্রায় প্রতিদিন নানান রকম খবর শুনি। যেমন- কারোর বিয়ে হয়েছে, কার...

বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথালয় এর সংযুক্তিকরণ

আমি কিছু ছোট ছোট old age home এবং orphan home এ গেছি এবং সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে বৃদ্ধ মানুষগুলো তাঁদের পরিবারের ছোটো-ছোটো নাতি-নাতনীদের মিস করেন। আবার অনাথালয়ের orphan দের কাছে গিয়ে মনে হয়েছে তারা যদি দাদু ঠাকুমাদের মত কাওকে পেত, যারা তাদের একটু গল্প বলবে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের আদর করবে তাহলে তারাও হয়ত অনেকটা ভালো থাকত। তাই আমার মনে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম ও orphan home যদি একই ছাদের নীচে করা সম্ভব হয় তাহলে ওইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার যে কষ্ট, সেটা সামান্য হলেও লাঘব হবে। এবার আমি এটা নিয়ে কতটা ঠিক ভেবেছি বা এটা ইমপ্লিমেন্ট করা কতটা সম্ভব বা তার প্রতিবন্ধকতার জায়গা গুলো আমি সম্পুর্ন ওয়াকিবহল নই। সম্পূর্ণ একটা ইমোশনাল ভাবনা থেকে এটা আমি ম্যাডামকে জানিয়েছি। ম্যাডাম বা ডিপার্টমেন্ট এ যারা দীর্ঘদিন ধরে অনেক গুরুদায়িত্ব সামলেছেন তাঁদের সবার পর্বত সমান অভিজ্ঞতা। যদি তাঁরা এই ভাবনার মধ্যে কোনো পজিটিভ দিক আছে বলে মনে করেন এবং প্রাকটিক্যাল গ্রাউন্ডে এটা ইমপ্লিমেন্ট করা সম্ভব মনে করেন এবং এক ছাদের তলায় old age home এবং orphan home তৈরী করা...