Skip to main content

আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতামত

আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সত্যি বলতে গেলে, তখন বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগ করা এবং না করা নিয়ে তখন একটা আন্দোলন চলছিল। রবীন্দ্র-নজরুলের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল খুন শব্দ কে কেন্দ্র করে। একটি কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-
"উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার"

কাজী নজরুল ইসলাম 'কান্ডারী হুশিয়ার' কবিতায় খুন শব্দটি ব্যবহার করেছেন জেনে 'বাংলার কথা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আপত্তি জানিয়েছিলেন। একথা জেনে নজরুল আবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন 'বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ' প্রবন্ধে (১৯২৭) । নজরুল নিজের আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহারের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, এই আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগ কবিতায় শুধু আমি করিনি আমার বহু আগে ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ করে গেছেন। তার উত্তরের রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল,

"হত্যা অর্থে খুন শব্দ ব্যবহার করলে সেটা বেমানান হয় না। বাংলা সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলেনি।"

এ প্রসঙ্গে আবুল ফজল রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা'য় খুন শব্দ ব্যবহারের অর্থ তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। বস্তুত বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগ নিয়ে তখন একটা আন্দোলন চলছিল। আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগের পক্ষে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য মৌলবাদীরা। অন্যদিকে আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগের বিপক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রাজশেখর বসু প্রমুখ।

রবীন্দ্র-নজরুল বিরোধীতাটিকে প্রমথ চৌধুরী 'বঙ্গ সাহিত্যে খুনের মামলা' নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী এক্ষেত্রে 'বাল্মিকী প্রতিভা'য় রবীন্দ্রনাথের নিজেরও খুন শব্দ ব্যবহারের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তবে এই কথা ঠিক রবীন্দ্রনাথ যখন ওই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তখন তিনি যথেষ্ট নাবালক ছিলেন। পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি অনুভব করেছেন এবং আলতাফ চৌধুরী নামে এক সাংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেেন। 

১৯৩২ সালে রমেশচন্দ্র মজুমদার ডক্টর মোহাম্মদ সাইদুল্লাহ সাহেবের 'মক্তব মাদ্রাসা শিক্ষা দ্বিতীয় ভাগ' এবং অন্য এক লেখকের গ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন 'মক্তব মাদ্রাসার বাংলা ভাষা' প্রবন্ধে। সেখানে তিনি প্রদত্ত শব্দার্থের কয়েকটি বিবরণ দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ আবার রমেশচন্দ্রের উক্ত প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টেনে সূক্ষ্মভাবে বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন 'প্রবাসী' পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায়। তিনি বলেছিলেন,

বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সমাজের পরিচয় নেই এতে অন্যের দোষ না দিয়ে নিজেরা কেন মুসলমান সমাজের কথা তুলে ধরেনি তার বিচার করা দরকার।  তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, মুসলমানরা এসব না ভেবে হিন্দুরা কেন তাদের নিয়ে সাহিত্য লেখেননি তা নিয়ে তর্ক করতে শুরু করলো।

সাহিত্য রচনাকে কেন্দ্র করে এভাবেই বিচ্ছেদের বীজ ক্রমশ অঙ্কুরিত হতে লাগলো। এই বিভেদের বীজ শুধু মুসলমানদের মধ্যে নয় বাংলা মুসলমানদের ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা দিতে শুরু করেছিল। বাঙালি মুসলমানদের ভাষা উর্দু হবে না বাংলা হবে তানি একটা সমস্যা তৈরি হল। আসলে এক শ্রেণীর মুসলমানদের মনে আশরাফ অর্থাৎ অভিজাত ও শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে উর্দুকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। এর ফলে বাংলা ভাষা মুসলিম সমাজের বিভেদের বীজ ক্রমশ অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল। মক্তব মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক ছাড়িয়ে নতুন মুসলমানি বাংলা রচিত সাহিত্যে অকাতরে উর্দু আরবি প্রার্থী ফার্সি শব্দ প্রযুক্ত হতে লাগল।

'মাহেনও' মাসিক পত্রিকায় মুদ্রিত একটি গল্প থেকে প্রাবন্ধিক এ জাতীয় ভাষার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। নায়কের সামনে নায়িকার ঘর্মাক্ত কলেবর অবস্থা বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন-  "লেবাসের অন্দরে তার তামাম তনু পসিনায় তরবতর" বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সির শব্দ ব্যবহারের বিতর্কটি বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।


আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য খুব পরিষ্কার ছিল। ১৯৩২ সালে প্রবাসী পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যার পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন, সহজ বাংলা ভাষায় শব্দের সহজ সরল শব্দ যেমন হাজার, মেজাজ, বেচারা, বদমাইশ, নেশাখোর ইত্যাদি ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু শিশু পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রে গায়ের জোরে আরবিয়ানা বা ফারসিয়ানা কোন প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেননি।

আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের মতামত। 

Popular posts from this blog

আগে এত মহাপুরুষ কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নিতেন?

রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মহারাজকে কিছু দিন আগে প্রশ্ন করা হয়, "মহারাজ, এত মহাপুরুষ কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নিতেন? আর বর্তমানে কেন আর সেই মহাপুরুষরা জন্মায় না?" অসাধারণ উত্তরে মহারাজ একটি বাণী উদ্ধৃতির মাধ্যমে বলেছিলেন, "আকাশে প্লেন ওড়ে, সে তো আর যেখানে সেখানে ইচ্ছামত নামতে পারে না! তার নামার জন্য উপযুক্ত এয়ারপোর্ট প্রয়োজন হয়। ঠিক সেই রকম এক সময় ছিল যখন এই ভারতবর্ষে উপযুক্ত ' মা ' ছিল। এখন সেই এয়ারপোর্ট নেই, তাই বড় বড় প্লেন আর নামতে চাইলেও পারছে না"। আধুনিক মনঃ বিজ্ঞানের মতে, সন্তান কেমন মানুষ হবে সেটা ৮৫% নির্ভর করে মা-এর উপর। আর তা নির্ধারণ হয়ে যায় মায়ের গর্ভে সন্তান আসা এবং জন্মের ৫ বছরের মধ্যে। মায়ের চিন্তা, কথা, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, রুচি, আদর্শ, সন্তানের উপর দারুনভাবে প্রভাব ফেলতে থাকে গর্ভে থাকা অবস্থাতেই। মায়ের কষ্ট, তার কষ্ট। মায়ের আনন্দ, তার আনন্দ। মায়ের খাবার, তার খাবার। তাহলে মায়ের ইচ্ছা, তার ইচ্ছা হবে না কেন! মায়ের আদর্শ তার আদর্শ, মায়ের জীবনবোধ, সন্তানের জীবন বোধ হবে। সেখান থেকেই তার শিক্ষা শুরু 3 Idiots এর All is Well এর মত...

ইতিহাসের পাতা থেকে - কামিনী রায়

"কেন একজন নারীকে ঘরে বন্দী করে সমাজে তার ন্যায্য স্থান থেকে বঞ্চিত করা হবে?" গর্জে উঠেছিলেন কামিনী রায়। কে ছিলেন এই প্রতিবাদী নারী? আজ বলবো তাঁরই কাহিনী। কামিনী রায় ছিলেন একজন কবি এবং ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা যিনি অনার্স ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হয়েছেন, যিনি তার সমগ্র জীবন নারী শিক্ষা ও অধিকারের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং যিনি তার কর্মের মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাসে একটি আলাদা ছাপ রেখে গেছেন। 1864 সালের 12 অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন কামিনী। অল্প বয়স থেকেই কামিনী সমাজে নিজের জায়গার জন্য লড়াই শুরু করেন। তিনি গণিতে পারদর্শী ছিলেন, কিন্তু কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি তিনি তীব্র অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। 1880 সালে, তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে যোগদান করেন, যেখানে তিনি তার সমসাময়িক, আর এক ভারতীয় নারীবাদী অবলা বোসের সাথে নারীবাদী লেখার অন্বেষণ শুরু করেন। 1886 সালে, 22 বছর বয়সে, তিনি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা হয়েছিলেন যিনি অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন, সংস্কৃতে বিএ সহ স্নাতক হন। তিনি একই বছর একজন শিক্ষক হিসাবে কলেজে যোগদান করেন। কামিনী তার প্রথম কবিতার বই, 'আলো ও ...

দাবাড়ু প্রজ্ঞা!

১০ আগস্ট, ২০০৫'র কথা। তামিলনাড়ু স্টেট কর্পোরেশন ব্যাংকের চাকরিজীবী রমেশ বাবু এবং তাঁর স্ত্রী নাগালাক্সমী'র ঘরে দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম হলো একটি ছেলের। ভারতের ঐ জায়গাটায় সাধারণত সন্তানদের নামের সাথে বাবার নাম যুক্ত করার রীতি আছে, এবং সে রীতি অনুযায়ী আগত সন্তানের নাম রাখা হলো প্রজ্ঞানন্দ, বাবার নাম যুক্ত করার পর ছেলেটার পুরো নাম দাঁড়ালো: রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। আর তাঁর বড় বোন: রমেশবাবু বৈশালী। প্রায় কাছাকাছি বয়সের প্রজ্ঞা আর বৈশালী'র বড় হয়ে ওঠার গল্প প্রায় একই, এবং তাদের মধ্যে একটা বিশেষ মিল আছে- দুজনই দাবাড়ু। দাবাড়ু প্রজ্ঞা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় আসে মাত্র দশ বছর দশ মাস এবং উনিশ দিন বয়সে- ২০১৬ সালের ২৯-এ মে'র ঘটনা। কেআইআইটি ইন্টারন্যাশনাল ওপেন টুর্নামেন্টের নবম রাউন্ডে আল মুথাইয়া'র সাথে খেলা গেমটা জেতার মাধ্যমে প্রজ্ঞা তাঁর আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাবটি নিশ্চিত করেন। শুধু খেতাব পেয়েই শেষ না- প্রজ্ঞানন্দ হয়ে ওঠেন বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী আন্তর্জাতিক মাস্টার! তাঁর ঠিক দুই বছর পর, ২০১৮ সালের ২৩-শে জুন প্রজ্ঞা ইতালিতে অনুষ্ঠিত একটি টুর্নামেন্ট খেলার ম...