সম্পর্কে তিনি আমার দিদার ছোটবোন। আমরা বলতাম 'মাসিদিদা'! মাসিদিদার বিয়ে হয়েছিল জনাই মিত্রবাড়িতে। জমিদার পরিবারের বড় বউ। তবে দুর্ভাগ্য সঙগে নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি। স্বামী আদ্যন্ত লম্পট এবং বিভিন্ন যৌনরোগগ্রস্ত! ফলশ্রুতিতে দিদা সারাজীবনের মত অপুত্রক রয়ে গেলেন। লম্পট ভদ্রলোকটি গত হলেন তাঁর পঞ্চান্ন বছর বয়সে। এবারে শুরু হল দিদার বৈধব্য জীবন।
জনাইয়ের শ্বশুর বাড়ি এবং দর্জিপাড়ায় বাপের বাড়ি - মিলিয়ে মিশিয়েই দিন কাটাতেন দিদা। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি, জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ল। বোনপোদের সম্মিলিত চিকিৎসায় টিউমারটি যে ম্যালিগ্নন্যান্ট, ধরা পড়তে বিলম্ব হলনা। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফ্রি ওয়ার্ডে চিকিৎসা শুরু হল।
একে কপর্দকহীন, তায় ঘোর জেদি - ভদ্রমহিলা যেদিন বুঝতে পারলেন, সময় প্রায় শেষ, শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অদ্ভুত জেদ করতে শুরু করলেন। মধ্যবিত্ত বোনপোরা একদিন বাধ্য হল অ্যামবুলেন্সে করে জনাইয়ে পৌঁছে দিতে।
তারপরে তাদের নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়াল পালাক্রমে জনাইতে দেখা করতে যাওয়া। মনে আছে, একদিন ছোটমামার পালা ছিল। ছোটমামা বাড়ি ফিরে খবর দিল - দিদার শ্বশুরবাড়ির সম্বন্ধীরা তাঁকে কলকাতার এক বিখ্যাত হাসপাতাল 'নির্মল হৃদয়ে' স্থানান্তরিত করেছে!
কালীঘাটের নির্মল হৃদয়ের ব্যাপারস্যাপার কারওরই সবিশেষ তেমন জানা ছিল না। খটকা লাগল, রোগীর সাথে দেখা করতে গিয়ে। নির্মল হৃদয় প্রথমেই রোগীর অবস্থিতি ডিনাই করল। জানা গেল, তাঁরা কেবল আত্মীস্বজনহীন মানুষদেরই গ্রহণ করেন। দিদা যেহেতু কোনও একটি পরিবার থেকে এসেছেন, অতএব দিদার অ্যাডমিশন নির্মল হৃদয়ে হতেই পারেনা। তথ্য ভুল।
মামারাও ছাড়বার পাত্র নন। বার কয়েক জনাই-দর্জিপাড়া যাতায়াত এবং কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে আলাপ - এই দুইয়ের ফলশ্রুতিতে জানা গেল, দিদার মেজো দেওর সহায়-সম্বলহীন হিসেবেই, তাঁকে নির্মল হৃদয়েই ভর্তি করেছেন। সেখানে দিদার পরিচয় - বাড়ির সামনে পড়ে থাকা ভিখারিনী হিসেবেই।
অতএব, ব্যাক টু কালীঘাট! কিন্তু অবস্থা পাল্টালো না। তাঁরা রোগীর সাথে দেখা করতে দেবেন না। কিছুতেই না। ছোটমামা কিঞ্চিৎ হুজ্জতি প্রবণ মানুষ। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটি চোখাচোখা বাক্যবাণ প্রয়োগ করতেই কালীঘাট থানার পুলিশ এসে গ্রেফতার করল তাঁদের। বুঝতে বিলম্ব হল না - ধর্মহীন মার্ক্সবাদী সরকারের ধার্মিক সংগঠনের সাথে খুব মজবুত যোগাযোগ!
জানেন, মাসিদিদা এরপরে জাস্ট হারিয়ে গেলেন। একে তো তখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ নয়। তার ওপর কলকাতায় তখন ছোটখাটো সোভিয়েতের শাসন। খুব বেশি আলোড়ন করবার সুযোগই ছিল না। মাস ছয়েক বাদে শেষ খবরটা আনলেন আমার বোবো মামা। তাও সংশ্লিষ্ট হাস্পাতালের এক নিম্নস্তরের কর্মীকে কিঞ্চিৎ রৌপ্যমূল্যের দক্ষিণা দিয়ে।
দিদাকে সোদপুর-পানিহাটির দিকে অবস্থিত কোনও এক সেন্টারে কবরস্থ করা হয়েছে। এমনটা ওনাদের গতাসু সমস্ত পেশেন্টদেরই করা হয়। মামা তাজ্জব! "ওমা! ওনাকে কবর কেন দেওয়া হয়েছে" - মামার জিজ্ঞাসা। তাতে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীটি জানিয়েছিলেন - "আমাদের এখানে তো কেউ হিন্দু হয়ে মরে না"!
হ্যাপি বার্থডে, হেলস এঞ্জেল!
✒️ Kaushik Kisore Roy