এরপর শুরু হবে বাঙালির জাতীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। হ্যাঁ ঠিকই 'উৎসব'। পুজো নয়। পুজো বহু পূর্বে হতো - যখন থীম, অষ্টমীর খিচুড়ি ঈদের সিমুইয়ের মিশে যায়নি। হ্যাঁ তখন শান্তিদূতের আক্রমনে বাংলায় রাজকীয় ঐশ্বর্য্য, দেবীর প্রাচীন শাক্ত আরাধনা, স্থায়ী প্রতিষ্ঠিত মূর্তি রাখার প্রথা গত হয়েছে। ঠাকুরদালানে তখন খড়ের কাঠামো টুকু রাখা থাকতো। তবুও কিছু অবশিষ্ট ছিলো তখন।
তখন দেবী দশভূজাকে "বাড়ির দরদালান থেকে নেমে
বারোয়ারি মন্ডপে " দাঁড় করানো হয়নি। আগে রথযাত্রা থেকে উপাচার শুরু হতো, মহালয়া, দেবী আগমন, বোধন, নবপত্রিকার স্নান, ষড়রিপুকে আবদ্ধ করে পুরোহিতগন দেবীর সামনে হোমানলে আহুতি দিতেন। সন্ধিপুজো ছিলো মহাক্ষন! হতো চন্ডী পাঠ! হতো রিপু বলি! কঠোর নিষ্ঠায় এতটুকু বিচ্যুতি হলে, গৃহকর্তা র মন ভারাক্রান্ত হতো। প্রায়শ্চিত্ত করতেন নিষ্ঠা ভরে।
পুজো, উপবাস, নিয়ম নিষ্ঠার পাশাপাশি ভোগ রান্না, খাওয়াদাওয়া, প্রসাদের রকমফের, আমোদ আহ্লাদ, নাচ গানবাজনা, যাত্রাপালা তখনো হতো। অঞ্চলের অধিবাসীরা সবাই উৎসবে মেতে থাকতেন।
ধীরে ধীরে বাংলায় এলো বিষাক্ত বহির্ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা। একশ্রেণীর মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা হলো "আমরা সবাই রাজা" আদর্শে। যা শ্রবন যোগ্য হলেও পরিচালন অযোগ্য, ভেঙে পড়লো সামাজিক কাঠামো। সম্ভ্রান্ত পরিবার গুলিতে শুরু হলো লুট, ডাকাতি, হত্যা। শুরুহলো জমির জবরদখল, জায়গার জবরদখল। অভিজাত একান্নবর্তী পরিবার গুলি পৃথক হতে শুরু করলো। বহু সদস্য জীবনের সুরক্ষায় গ্রাম ছেড়ে শহরে বাস করতে শুরু করলেন নিজের নিজের সংসার শুরু হলো। তৈরি হলো "শরীক"!
অধিকারের দাবীতে চাষযোগ্য জমিতে শুরু হলো "বর্গা"! একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের ফলে আর্থিক অনটন শুরু হলো সমাজে। শরীকদের সম্পত্তির অধিকারের লড়াই শুরু হলো পরিবারের মধ্যে ।
জমির বর্গা তো হলো, শ্রমিকরা বর্গাদার হলেন, কিন্তু পুঁজি আর জ্ঞানের অভাবে জমিগুলিতে ফসল উৎপাদন কমতে শুরু হলো। শুরু হলো গ্রামবাংলার জনজীবন ও ভূমিরূপের পরিবর্তন। দেওয়ানী সমস্যায় সুযোগ নিলো কিছু বহিরাগত। তারা তাদের জমানো পুঁজি দিয়ে কিনতে লাগলো সাবেকি জমি গুলি। গড়ে উঠলো ছোট ছোট মসজিদ, মাদ্রাসা আর কবরাস্তানা।
শরীকদের মধ্যে আর্থিক অনটনের প্রভাব পড়লো বাংলার চিরাচরিত শক্তি সাধনায়। জাঁকজমক কমে এলো। শুরু হলো কোনোমতে " নম নম "করে পুজো সম্পন্ন করার প্রথা। বেশিরভাগ দরদালানে শুরু হলো গ্রামবাসীদের যৌথ উদ্যোগে পুজো করা বারোয়ারী হলেন মা।
ঠিক যেমন বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্বভার বছরের ৩৬৫দিনের হিসেবে ভাগ হয়ে গেলো সন্তানদের মধ্যে। দেবী আদ্যাশক্তি হলেন ভাগের মা। তারপর অবক্ষয় আর স্থির থাকেনি। তার গতি হয়েছে দ্রুত।
আজ না সময় না দিনক্ষন, মা আসেন ক্লাবের উদ্যোক্তাদের ইশারায়। শিল্পী সত্তার বিকৃতিতে তার রূপমন্দনা হয়ে যায় বিকৃত। কোথাও দেবী আয়ুধহীন, কোথাও দেবী বিবস্ত্রা কোথাও দেবী র অসুরদলনী রূপবিহীন
সন্ধিপুজোর মহাক্ষনে আজ বাঙালি আরসালানের বিরিয়ানি র লাইনে দাঁড়ায়। প্রতিটি সময় পুজোর নিষ্ঠা পরিবর্তিত হয়েছে ফ্যাশন ট্রেন্ডে।
আর নীলকন্ঠ পাখি আসেনা। বাঙালি এখন আর উমাকে
জড়িয়ে কাঁদেন না। সিঁদুর দান আর হয়না, হয় সিঁদুর খেলা।
হোলিফেস্টের মতো সিঁদুর ফেস্ট। সবাই নাচেন হাসেন গান
বাজে...জমা আসর, থাকবে মা আর কতক্ষন!
বাঙালির অবক্ষয়য়ের কি দুর্ভাগ্যজনক পরিহাস!
না এখন আর বিসর্জন ও নিয়ম মেনে হয় না ।
রাজনীতির ময়দানে এখন পূজিত প্রতিমারা নগরনটীর মতো রাস্তায় প্রদর্শিত হয়। যার নাম "কার্ণিভ্যাল"!
জানি এই লেখাটা আপনাদের পুরোটাও পড়তে ইচ্ছে হবে না। কমেন্ট আসবে - আমরা কি একটু আনন্দ ও করতে পারবো না!!"
হ্যাঁ বাঙালি তুমি আনন্দ করবে! আনন্দ করা তোমার অধিকার । তবুও অন্ধকারে একবার নিজের অন্তরে খুঁজো বাঙালি! নিজেকে খুঁজো। একটু শিকড়ে র সন্ধান কোরো। শুধু একটু ভালোবাসা, ভক্তি আর সমর্পন ই তো লাগবে। আর কিচ্ছু নয়। মা কে মায়ের ঐতিহ্য থেকে আর কতো নীচে নামাবে!!!