Skip to main content

বাঙালির প্রতিরোধ দিবস

প্রতিরোধে গোপাল পাঁঠা ও অন্যান্যরা :

কলকাতা গণহত্যায় হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে যাঁর নাম অনস্বীকার্য হয়ে উঠে আসে তিনি হলেন গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তবে আমাদের তখনকার সমগ্র পরিস্থিতিটাই বিচার্য হওয়া উচিত, যাতে বোঝা যায় নেতাকে ‘পরিত্রাতা’ হতে গেলে যোগ্য সঙ্গত ও প্রস্তুতি দরকার। সে প্রস্তুতি ও নেতৃত্বে সক্ষম হয়েছিলেন গোপাল মুখোপাধ্যায়।


আসলে ঘটনাটা অতর্কিত নয়, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি আঁচ করে হিন্দু মহাসভাও হিন্দুদের প্রস্তুত থাকতে বলেছিল। ‘হিন্দু সেবক সঙ্ঘ’ মুসলিম লীগের উর্দু প্রচারপত্রের পাল্টা প্রচারপত্র ও পোস্টার লাগায়: “সাবধান! ১৬ই আগস্ট”। নির্দেশ ছিল লীগের স্বেচ্ছাচারিতা ভেঙে সমুচিত জবাব দেওয়ার: “Hindus will have to give clear reply to the highhandedness of the Muslim Leage.”  পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়াম সমিতিগুলোর ওপর হিন্দু মহাসভার একটা প্রভাব ছিল, সহযোগিতাও ছিল। মণিকুন্তলা সেনও একই কথা জানিয়েছেন, “লীগের ডাকা মিছিল থেকে কিছু একটা অঘটন ঘটবে এটা সবাই অনুমান করছিল। সুতরাং হিন্দুরাও পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হলো।"


গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কলেজ স্ট্রীটে পারিবারিক মাংসের দোকান ছিল, যা দেখাশোনা করার সুবাদে তাঁর ব্যাঙ্গাত্মক ডাক নাম জুটেছিল ‘গোপাল পাঁঠা’। ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সেই দুর্দিনে অনেক ভদ্রসন্তানও ময়দানে নামতে বাধ্য হন। গোপাল মুখার্জী ছিলেন তেমনই একজন। তার ব্যবসার একটি অংশ হিসাবে, তার নিয়মিতভাবে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মুসলমানদের প্রতি তিনি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন না। কিন্ত পরিস্থিতি তাকে পথে নামতে বাধ্য করে। 


গোপাল মুখোপাধ্যায়ের পরিবার ১৮৯০-এর দশকে পূর্ববঙ্গের চৌডাঙা জেলার জীবননগর থেকে কলকাতায় এসে বৌ-বাজারের মালঙ্গ লেনে বসবাস শুরু করেন। গোপালের কাকা অনুকূলচন্দ্র ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ও একজন বিপ্লবী, যাঁকে স্বাধীন ভারতে ১৯৬৪ সালে মরণোত্তর পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়।


গোপাল আগে থেকেই অরবিন্দের ভাবশিষ্য ছিল। সে ছিল নির্ভিক ডাকাবুকো। একাই দশজনার সাথে লড়ার মত পেটানো শরীর ছিল তার। ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সে সামিল ছিল। তার কাছে বেশ কিছু অস্ত্র ছিল। কিছু পিস্তল, বোমা এবং কিছু সোর্ড। কিন্তু কখনো তা কোন ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটিস -এ ব্যবহার করেনি বা করতে দেয়নি গোপাল। 


মাংস ব্যবসার দৌলতে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠা-বসা, বন্ধুত্ব। ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ একাধিক গবেষকের মতে মুসলিমদের প্রতি কোনও বিরূপতা বা ভীতি কোনওটাই ছিল না গোপালের মধ্যে। তাছাড়া পরোপকারী হিসাবেও পাড়ায় পরিচিতি ছিল। তবে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের পরিবর্তে তাঁর আদর্শ ছিল নেতাজীর সশস্ত্র বিপ্লব। সেই উদ্দেশ্যে অল্পবয়সী ছেলেদের নিয়ে ‘ভারতীয় জাতীয় বাহিনী’ নামে একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যার কাজ ছিল দুর্গতদের সেবা করা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ দেওয়া। বাহিনীর অনেক সদস্যই ছিল কুস্তিগীর। কলকাতা দাঙ্গার সময় গোপালের বয়স ছিল ৩৩ বছর।


২৯ শে জুলাই ১৯৪৬ -র বোম্বে অধিবেশন থেকে মুসলিম লীগের নেতা মহঃ আলী জিন্নার পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে "Direct Action Day" বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের আহ্বানে, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬ কলকাতা মহানগরীর মাটিতে এক ভয়ঙ্কর হত্যালীলার পরিকল্পনা করে। মুসলিম লীগ সরকার খুব নিখুঁত হিসাব কষেই এগোচ্ছিল। সেই সময় কলকাতার মোট জনসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ যার মধ্যে ১২.৮ লক্ষ হিন্দু এবং ৬.৬ লক্ষ মুসলমান। তাদের মধ্যে ৩.৩৮ লাখ (৩০%) অবাঙালী, বাংলার ভারতে থাকা বা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যাদের মতামত খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যেহেতু তারা বহির্বঙ্গ থেকে আগত ভাবা হোত। অথচ কলকাতার হিন্দু বাঙালীদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় তাদের অংশগ্রহণের অনুপাত ছিল বাঙালী ভদ্রলোকদের তুলনায় অনেক বেশি। যাই হোক, ১৭ই আগস্ট রাত্রির মধ্যে কম-বেশি ৭০০০ হিন্দু খুন হয়েছিল, যার ফলে বাকিরা পালাতে শুরু করে। দেখা গেছে, প্রতি ১০০ খুনে ৪০০০ হিন্দু প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছিল। সুতরাং ১৮-১৯ তারিখের মধ্যে আরও ৫০০০ মানে মোট ১২০০০ হিন্দুকে খুন করা গেলেই ৪,৮০,০০০ হিন্দুকে কলকাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করা যেত। মানে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপের আগেই কলকাতায় হিন্দুর সংখ্যা ৭.৮ লক্ষে নামিয়ে আনা যেত, যেটা মুসলিম জনসংখ্যার চেয়ে সামান্য বেশি। পরে তাদের মুছে ফেলা বা দমিয়ে রাখাটা কোনও ব্যাপারই ছিল না। সোহ্‌রাবর্দির পরিকল্পনা ছিল কলকাতার আশপাশ থেকেও মুসলিম নিয়ে এসে হামলা চালানো, যাতে মৃত বা পলাতক হিন্দুদের জমি-বাড়ি সব কিছু মুসলিমদের দখলে চলে আসে।


সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ই আগস্ট সকাল থেকেই মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের মিছিল ও হিন্দুহত্যার খবর শোনা যায়। ১৭ই আগস্ট ব্যাপক হারে হিন্দু হত্যা ও নারী ধর্ষণের ভয়াবহ খবর পেয়ে নিজের ছেলেদের প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন গোপাল। তাদের মধ্যে বীডন স্ট্রীটের বাসিন্দা ও ঐ এলাকার দায়িত্বে থাকা বসন্ত নামে এক কুস্তিগীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। 


১৭ ই আগস্ট রাতে আক্রমণ প্রতিহত করার পরিকল্পনা করা হয়। আত্মরক্ষার পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বেশ কিছু অবাঙালী হিন্দুও যোগ দেয় সেই বাহিনীতে। বড়োবাজার এলাকার মাড়োয়াড়িরা যাদের দোকান-পাট পুড়েছিল মুসলিম হানায়, তারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।  আগে থাকতে কিছু হাতবোমা মজুত রাখা ছিল। আর কিছু অস্ত্র যোগাড় করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এদেশে আসা আমেরিকান সৈনিকদের কাছ থেকে বোতল বোতল হুইস্কির বিনিময়ে। এরপর রডা কোম্পানীর বন্দুকের দোকান লুঠ করল গোপাল তার দলবলকে নিয়ে। 


একরাত্রে একত্রিত হয় প্রায় হাজারখানেক হিন্দু ও শিখ ছেলে। তাদের কয়েকটি কড়া নির্দেশ দিলেন গোপাল পাঁঠা। প্রথমত, অস্ত্রহীন মুসলমানকে মারবে না। উল্টে সে প্রটেকশন চাইলে তাকে বা তার পরিবারকে প্রটেকশন দেবে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম মা বোনেদের দিকে মুখ তুলে তাকাবে না। কিন্তু অস্ত্রধারী মুসলমানকে ছাড়া চলবে না। ধড় থেকে তার মুন্ডু উপড়ানো চাই।


এই প্রতিরোধ প্রস্তুতিতে হরেন ঘোষের কথা বলা খুব দরকার। হরেন ঘোষ নামে এক গানের শিক্ষক ছিলেন। সুরাবর্দীর মেয়েকে তিনি গান শেখাতেন। সেইসূত্রেই তিনি সুরাবর্দির বাহিনীর কলকাতার মেজর পয়েন্ট গুলো বোম চার্জ করে উড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র ধরে ফেললেন। সেখানে ছোট্ট মেয়েটি একটি কাগজ এনে হাজির করে। উনি প্রথমে বাজে কাগজ বলে মুড়ে ফেলে দেন পরে সেটা নিয়ে চুপ করে গোপালের কাছে তার বৌবাজারের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে হাওড়া ব্রিজ, টালার জল ট্যাঙ্ক, ভিক্টোরিয়া, শিয়ালদা স্টেশন কিভাবে বোম মেরে উড়িয়ে দেবে তার প্ল্যান করা ছিল। গোপালের বাহিনী সেই প্ল্যান অনুযায়ী প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়। গোপালের বাহিনী প্রতিটি জায়গা থেকে হামলাকারীদের হঠিয়ে দেয় (১৮ ই আগস্ট)। এরপর সুরাবর্দীর সন্দেহ গিয়ে পড়ে হরেন বাবুর উপর এবং তার প্রান যায় মুসলিম গুন্ডাদের হাতে। তার শরীরটাকে কেটে ছয় টুকরো করা হয়।

১৮ই আগস্ট- দুদিন একতরফা হিন্দু নিধনের পর ১৮ই আগস্ট ছিল পাঁঠার নেতৃত্বে সিংহ-বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ানোর দিন। গোপাল বাহিনীর এই প্রস্তুতির কথা সোহ্‌রাবর্দি ও লীগের দুষ্কৃতিরা জানত না। তারা মহা উৎসাহে ১৮-র সকালেও হিন্দু এলাকায় মৃগয়ায় বেরিয়েছে। সোহ্‌রাবর্দির নির্দেশে তাদের হাতে আর দু’দিন সময় ছিল হিন্দু সাফাইয়ের জন্য, কারণ দিল্লিতে খবর যাওয়ায় ওপর মহল থেকে হিংসা থামানোর জন্য চাপ আসছিল। সুতরাং ভাইসরয় হস্তক্ষেপ করার আগেই কাজ সেরে ফেলে অপরাধীদের পার্শ্ববর্তী জেলায় চালান করার তাড়া ছিল মন্ত্রীমশাইয়ের। সেদিন সকালেই ‘হিন্দু সাফাই অভিযাত্রী’র দল অতর্কিতে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে চম্পট দিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ মারাও যায়।


হানাবাজদের পর্যুদস্ত করে গোপালের বাহিনী অতঃপর মুসলিম এলাকায় গিয়ে কট্টর ইসলামপন্থীদের কচুকাটা করতে থাকে। উল্লেখ্য খুনের বদলা খুন হলেও ধর্ষণের বদলা ধর্ষণ হয়নি সেই প্রত্যাঘাতে। ছাড় দেওয়া হয়েছিল শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদেরও। গোপাল মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতি: আগে থাকতে কিছু হাতবোমা মজুত রাখা ছিল। কিন্তু এত বড় দাঙ্গা হবে ভাবা যায়নি। ১৬ তারিখে পাড়ার কিছু মুসলমান পরিবারকে থানায় পৌঁছে দিয়ে আসা হয়। এক মুসলমান যাদুকর বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় হিন্দু যুবকরা। কিন্তু ঐ দিনই সন্ধ্যের পর থেকে বীভৎস দাঙ্গার খবর আসে। জানা যায়, স্থানীয় ফিয়ার্স লেনে, সাগর দত্ত লেনে প্রচুর হিন্দু মারা পড়েছে। তখন ঠিক করা হয়, একটা হিন্দুর লাশ দেখলে দশটা মুসলমানের লাশ ফেলতে হবে। তারপর একদিকে চলে হিন্দুদের রেসকিউ করা, আর অন্যদিকে হিন্দু হত্যার বদলা নেওয়া। 


ঐতিহাসিক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, তিনি আরও লিখেছেন গোপাল কখনই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, শুধু আত্মরক্ষার্থে হিন্দু যুবকদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের গৃহহীন ও বিধবাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তাদের খুন বা ধর্মান্তরিত হওয়া থেকেও রক্ষা করেছিলেন।

১৭ ই আগস্ট বিকেলের পর সেনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ১৮ ই আগস্ট থেকে বাস ও ট্যাক্সি চেপে বের হয় হিন্দু ও শিখ হাতে লাঠি, তরোয়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। শোনা যায়, রাতারাতি কামারশালায় তরোয়াল, বর্শা, কাটারি ইত্যাদি তৈরি হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শোনা, দেশপ্রিয় পার্ক এলাকায় রাস্তার ধারে একটাও রেলিং অবশিষ্ট ছিল না, চলে গিয়েছিল কামারশালে। তৈরী হয় প্রচুর অস্ত্র। যেসব নেতারা হিন্দু হত্যায় প্ররোচনা বা আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিল, শুধু তাদের সনাক্ত করে হত্যা করা হয়। 


১৮-২০ আগস্ট মুসলিম লীগের ঘাতকদল সমুচিৎ জবাব পেয়ে যায়। সোহ্‌রাবর্দি ও তার সাকরেদরা এবং হিন্দু বিদ্বেষী কলকাতা পুলিসের আধিকারিক ও সিপাইরা – কেউ সেই প্রতিরোধ ও প্রত্যাক্রমণ আটকাতে পারল না। হিন্দুদের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব ছিল গোপাল মুখার্জী ও তাঁর অনুগামী বসন্ত নামক কুস্তিগীরের সক্রিয় নেতৃত্বে তাঁদের সতীর্থদের ভূমিকা ছাড়া। কিন্তু একই সঙ্গে পেশিবল দিয়ে সেই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়েছিল বিহার ও ইউনাইটেড প্রভিন্সের দলিত ও অবাঙালী হিন্দুরা, অর্থ সাহায্য করেছিল মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ এসেছিল ভবানীপুর গুরুদ্বার থেকেও। তাছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী গোপালবাবুরা মূলত উত্তর কোলকাতায় সক্রিয় ছিলেন, যেখানে দক্ষিণ কলকাতাতেও যে প্রতিরোধ বা প্রত্যাক্রমণ হয়েছিল তা অনেকটাই ভবানীপুর অঞ্চলের শিখদের প্রভাবে। তখন বাঙালী লক্ষ্মী ছেলেরাও যে ইঁদুরের গর্তে ঢুকে বসে থাকেনি, তার প্রমাণ রাশবিহারী বসু রোডের ধারে বসা কামারশালায় রাস্তার রেলিংগুলির সদ্‌ব্যবহার। অনেকের মতে, দাঙ্গাটা কার্যত গুণ্ডাদের হাতে চলে যায়। কিন্তু সেই গুণ্ডাদের দাক্ষিণ্যেই বক্তারা বেঁচে আছেন।


অনেকেই অপর সম্প্রদায়ের নিরপরাধ মানুষকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রক্ষা করেন। অভিনেত্রী সন্ধ্যারানী ছিলেন তেমন একজন। এই মহানুভবতা প্রদর্শনে বলা বাহুল্য হিন্দুরা অনেক বেশি সংখ্যক হলেও বিচ্ছিন্নভাবে মুসলিমরাও দু-একজন নাকি কিছু হিন্দুকে রক্ষা করেছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সবাই তখন দূর থেকে মজা দেখেননি। কংগ্রেসের বিজয় সিং নাহার, পবিত্রকুমার দে প্রমুখ দু-একজন নেতাও লুঠপাট থামাতে দাঙ্গা থামাতে উদ্যোগ নেন, এবং হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্ধারও করেন।


সোহ্‌রাবর্দির কাছে বাঙালী হিন্দুর এই পাল্টা মার দেওয়ার ব্যাপারটা ছিল অভাবনীয়। ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় দৃশ্যত তাঁকে হতাশ হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে শান্তি প্রস্তাব দেন। সেটা তাঁকে দিতেই হত, না হলে দাঙ্গার মোড় ঘুরে যাওয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা আরও হ্রাস পেত। দাঙ্গা থামানোর দায়িত্ব দেন মুসলিম লীগের ছাত্র নেতা জি. জি. আজমেরি ও Muslim National Guard-এর দায়িত্ব থাকা মুজিবর রহমানকে, যাঁরা প্রথম দিকে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বেই ছিলেন।


হিন্দুঘাতী মার চলা কালে ‘জাতির জনক’-এর টনক নড়েনি, কিন্তু পাল্টা মারে মুসলিমরা আক্রান্ত খবর পেতেই গান্ধীজী যথারীতি কলকাতার হিন্দুদের কাছে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ত্যাগ করার ও তাঁর কাছে অস্ত্র সমর্পণের আবেদন করেন। গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছেও অস্ত্রত্যাগের ব্যক্তিগত আবেদন রাখেন। জনৈক কংগ্রেসি নেতা আবার গোপালকে বাপুজীর পায়ে অস্ত্র সমর্পণ করার নির্দেশ দেন। গোপাল মুখার্জী জবাব দেন, “হিন্দুদের মর্যাদা রক্ষিত না হলে একটি পেরেকও জমা দেব না।” [I will not lay down even a nail if it has not been used for defending Hindu honour.] ভাগ্যিশ বলামাত্র গান্ধীজীর পরামর্শ মানার দুর্বুদ্ধি গোপাল বা তাঁর অনুগামীদের হয়নি। তিনি সোহ্‌রাবর্দিকে শর্ত দেন, মুসলিম লীগের ঘাতকরা আগে অস্ত্রত্যাগ করে হিন্দু হত্যা বন্ধ করুক। সেই শর্ত সোহ্‌রাবর্দি মেনে নিতে বাধ্য হন বলেই পশ্চিম বাংলা হিন্দুশূন্য হয়ে যায়নি।


সোহ্‌রাবর্দির এই পশ্চাদপসরণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ধৈর্য্যের শেষ সীমায় চলে গেছেন, যার ফলে সোহ্‌রাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকারকে বরখাস্ত করতে পারেন। তাই নিজের গদি ও মান বাঁচাতে শান্তির আবেদন করেন। কিন্তু ২১ আগস্ট সোহ্‌রাবর্দির সরকারকে বরখাস্ত করে বাংলায় ভাইসরয়ের শাসন জারি হয়। ব্রিটিশ ও গোর্খা পুলিস টহল দিয়ে সারা কলকাতা ছেয়ে ফেলে আবিষ্কার করে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের মৃত্যু হয়েছে বেশি।


তবে খুনি সোহ্‌রাবর্দির সেই ক্ষমতাচ্যুতি ছিল নিতান্তই সাময়িক। পার্লামেন্টে বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হলে, নমশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কংগ্রেসের সদস্য ভাঙিয়ে ভোটাভুটিতে সোহ্‌রাবর্দিকে জিতিয়ে দেন। রক্তের নদীতে নিজের রাজনৈতিক জীবনের ভেলা ভাসিয়ে তিনি পরে পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাবিনেট মিনিস্টার হন, যদিও টিঁকতে পারেননি।


সেই সময় গোপাল ও তাঁর ‘ভারত জাতীয় বাহিনী’-র ছেলেরা কলকাতার পরিত্রাতা হিসাবে নায়কোচিত সম্মান পেয়েছিলেন। গোপাল পরবর্তী জীবনে সমাজসেবা নিয়ে থাকতেন। তাঁর সেবা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল “National Relief Centre for Destitutes”। নিজের এলাকায় বারোয়ারি কালী পুজোও শুরু করেন। আজ গোপাল মুখোপাধ্যায় ঐতিহাসিক আলোচনায় যতই উপেক্ষিত হন, আর প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর স্বজাতি ও স্বধর্মের মানুষ যতই গালাগালি দিক, তিনি হাত-পা গুটিয়ে সুবোধ বালক হয়ে থাকলে শুধু যে কলকাতা হিন্দুশূন্য হয়ে যেত তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গেরও পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি আটকানো যেত না, তাঁকে গুণ্ডা দাঙ্গাবাজ বলার মতো বাঙালীরা হয়তো জন্মানোর সুযোগই পেত না।


কিন্ত এই গোপালবাবুকে নিয়ে ইতিহাসে আলোচনা বিস্ময়কর রকম নগণ্য। পাঠ্যসূচীতে তো নেইই, এমনকি আন্তর্জালকে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর আলোচনাতেও তাঁর নাম চোখে পড়েনি, পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে প্রচলিত কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার জন্য তাঁর নাম করে খোঁজাখুঁজি করতে। তবে অনেকে যেমন দাবি করে ১৬-১৭ আগস্ট দুই দিন হিন্দুরা একতরফা মার খাওয়ার পর ১৮ থেকে শুধুমাত্র গোপাল মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দান উল্টে গিয়েছিল, ঘটনা ঠিক তেমন নয়। গোলমালের আঁচ পেয়ে কিছুটা সতর্কতা হিন্দুদের তরফ থেকেও ছিল। নতুবা সেই বিপর্যয় ঝটিতি ও একক নেতৃত্বে আটকানো যেত না।


গান্ধী এবং কংগ্রেসের ভূমিকা :

যতদিন হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছিল কংগ্রেসী নেতারা ততদিন ঘাপটি মেরে বসেছিল। কিন্ত যেই মুসলমান মারা শুরু হল সেই সবাই আঁচলের তলা থেকে বেড়িয়ে এল। সবাই মিলে গোপালকে হাজির করল গান্ধীর সামনে। গান্ধী বললেন গোপাল আমার পায়ে তুমি অস্ত্র সমর্পন কর। গোপাল বলল এতদিন এত হিন্দু মরছিল আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, আমি আপনার কথা রাখতে পারব না। অস্ত্র যদি জমা দিতে হয়, নেতাজী সুভাষের আসার কথা আছে, ওর পায়ে দেব আপনার পায়ে নয়। বেগতিক দেখে গান্ধী সেখান থেকে পালালেন। দেখা করলেন ব্রিটিশ গভর্নরের সাথে দেখা করতে। কারণ তিনি কিছু সক্রিয় পদক্ষেপের কথা ভাবছিলেন।


এইসময় অশান্ত কলকাতাকে শান্ত করতে গান্ধীর পরামর্শ চেয়ে তাঁর কি করা উচিত তা জানতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ গভর্নর Frederick Burrows গান্ধী জবাবে বলেছিলেন, "Nothing Your Excellency"। রাজ্যে নির্বাচিত সরকার আছে। তাই, আপনার কিছু করার দরকার নেই। যা করার নির্বাচিত সরকারই করবে।

বাংলায় তখন ক্ষমতায় ছিল সোহ্‌ওয়ার্দী সরকার। তাই Frederick Burrows তাঁর সক্রিয় পদক্ষেপ কে থামিয়ে হিন্দুদেরকে সোহ্‌ওয়ার্দীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন গান্ধীর পরামর্শে।


আজকের যুব সমাজকে চাগিয়ে তোলার জন্য নায়ক নির্মাণ জরুরি মনে হয়েছে বলে হিন্দু সংগঠনগুলো যাবতীয় কৃতিত্ব গোপাল মুখোপাধ্যায়কেই দিতে চায়। কিন্তু হিন্দু মহাসভার শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষায় অনুপ্রেরণা এবং পূর্ব পরিকল্পনা আর গোপালের নেতৃত্ব ছাড়া এত দ্রুত পাড়ায় পাড়ায় সার্বিক প্রতিরোধ কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তখন কিন্তু বাংলায় ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির সোচ্চার আগমণ হয়নি, মুসলমানদের "আল্লাহ-হু-আকবর" এর সামনে শক্তি যুগিয়েছিল ‘বন্দে মাতরম’-এর দেশাত্মবোধই। প্রশাসনিক মদতে ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিরোধে ও তার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারার নেপথ্যে ছিল অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, আত্মোন্নতি সমিতি, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স – এই দলগুলির সক্রিয় ভূমিকা। সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, বিষ্ণচরণ ঘোষ ও তাঁর ছাত্ররাও। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইয়ে দাঙ্গা থামাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে শহীদ হওয়া পাঁচজনের নাম পাওয়া যায় – ভূদেব (ননী) সেন, স্মৃতিশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন্দ্র মিত্র, সুশীল দাশগুপ্ত, লালমোহন সেন। বর্তমানে গোপাল পাঁঠার মতো নেতৃত্ব কিংবা হিন্দু মহাসভার মতো এমন ভূমিকায় আর কোনও হিন্দু সংগঠনকে দেখা যায় না।