Skip to main content

দেশ আগে নাকি ধর্ম আগে

আমাদের মতে, দেশ আগে, ধর্ম পরে। দেশ-ই সব। দেশের স্বার্থে ধর্ম ছাড়তে পারি। কিন্ত ধর্মের স্বার্থে দেশদ্রোহীতা করা পাপ। এটাই আমাদের হিন্দুদের বক্তব্য। যদি এই বক্তব্য কে সমর্থন করা হয়, তবে বলা যায় পাকিস্তান আমার দেশ, আফগানিস্তানও আমার দেশ, বাংলাদেশও আমার দেশ।
কেনো আমরা আমাদের দেশ ছেড়ে চলে এলাম? কেনো থাকা গেলো না আমাদের সেইসব দেশে? দেশ সর্বোপরি, তাই দেশের স্বার্থে ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে দেশের সেবা করাই কি উচিত ছিল না? নাকি আমাদের কাছে ধর্ম বড়? তাই, ধর্ম রক্ষার্থে দেশ ছেড়ে চলে এলাম।


এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি, আমার দাদুরও একখান দ্যাশ ছিল। পরে সেই দ্যাশটি হারিয়ে যায় যখন, দাদু আর কোন মিসিং ডায়েরি করেনি। করবেই বা কোন থানায়? রিফিউজি ক্যাম্প থানায়? কলোনি থানায়? না নতুন বাড়ি বানালো যে দক্ষিণ কলকাতা এলাকায় সেই থানায়? নাকি ভিটেমাটি ছিল যেখানে সেই থানা। দাদুর একখান দ্যাশ ছিল। সেই দ্যাশে সুপুরি গাছ, নারকোল গাছ ছিল। খাল ছিল, বিল ছিল, নয়ামাটি, সাতক্ষীরা, বান্দরবান নামে সব মিষ্টি এলাকা ছিল, মহারশি, উদ্দাখালি, সনকোশ, হাড়িভাঙ্গা, খাসিমারা নদী ছিল, গোল্লাছুটের মাঠ ছিল, সন্ধেবেলার শাঁখ ছিল। আমন ধানের গন্ধ ছিল, ফজলুল চাচার থেকে কেনা রোববারের খাসির ঝোল ছিল। শীতে গাছিরা খেজুরের গাছ থেকে রস পেড়ে আনতো, দিদা-ঠাকুমারা তখন গিন্নি সব। দুধ গোকুল, পাকন পিঠে, গোলাপ পিঠে তৈরি হতো৷ দালানে অনেকের গরু বাঁধা থাকতো আবার সেই কবেকার নারায়ণ শালগ্রাম শীলাও ঘরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। দাদুদের একখান দ্যাশ ছিল কিন্তু জীবনে জাদুকর পিসি সরকার ছিল না। চোখের সামনে ভ্যানিশ হয়ে যায় জিনিস, সেই জাদুর খেলা না দেখে, দাদুদের প্রজন্ম দেখলো ভীটেমাটিচাটি হয়ে যেতে। একরাতে দাদুদের দ্যাশ থেকে চৈল্যা আসতে হইবো। রাতের অন্ধকারেই সেফ!

ঠাকুমারা বোকার মতো নিশ্চয়ই সেই রাতে প্রশ্ন করেছিল, "কও কী? মাথার ঠিক আছে? আমাদের দ্যাশ ছাইড়া যামু ক্যান! ফিরবো কবে? তুলসী গাছে জল দিতে হয় রোজ, ঠাকুরকে নকুলদানা দিতে হয়, ময়না পাখিটারে দানা। ওরা তো আমাদের ছাড়া মরে যাবে।" পৃথিবীর সব রিফিউজি বাবার মতোই আমার দাদুর প্রজন্ম নিশ্চিত সেসময় চুপ করে গেছিল বা রেগে বলে ফেলেছিল, "নিজের জান বাঁচে কিনা দেখো আর তোমার ময়না পাখি।"

শুনেছিলাম আমার দাদু দুটো বসার টুল নিয়ে চলে এসেছিল। আরেক বন্ধুর দাদু নাকি একটা কাঁচের হ্যাজাক। আমরা মানে যারা বিরিয়ানি আর বহুত্ববাদ এক থালায় সাজিয়ে খাই, কলকাতার কালচার মারাই তারা ফ্যাক করে হেসে দিয়েছিলাম। এতোকিছু থাকতে টুল আর হ্যাজাক? উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রথম জেনারেশন রিফিউজি পরিবার জবাবটা দিয়েছিল। এসব সময় হাতের কাছে যা পাওয়া যায় নিয়ে চলে আসে লোকে। ওই একখান সম্পত্তি তো ধরে রাখা গেল। বাকি সবটাই তো দুষ্টু লোকের মতো ভ্যানিশ ৷

কিন্তু কারা যে দুষ্টু লোক, সেই জটিল অংক না কষে দাদুরা নতুন দেশে মানিয়ে নিলো। কোনদিন আর দুষ্টু লোকদের বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো না। গোটাটা র‍্যাডক্লিফ সাহেবকে দোষ দিয়ে উদারপন্থী, প্রগতিশীল, বাস্তুহারা মানুষের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজলো বরং। দাঁত চেপে এপাড়ে টিকে থাকার লড়াই তখন। ভাত না দিলে মানচিত্র চিবিয়ে খাওয়ার হুমকি। ঘর হলো, কলোনিতে নতুন রাস্তা হলো, পাট্টা পেল, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্যপদ পেল। আর সারাজীবনের জন্য একটা নস্টালজিয়া ব্যামো পেল। "আমার একখ্যান দ্যাশ ছিল।"

সুতরাং দেশ বদলাতে থাকে। দেশ বদলানো সম্ভব। প্রাণ বাঁচাতে, মান বাঁচাতে, ধর্ম বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়। দেশকে "আমার দ্যাশ" বলে বুকে করে আঁকড়ে ধরে রাখা যায় না। সময় এলে ভিটে-মাটি ছেড়ে বের হতে হয় নতুন দেশের সন্ধানে। সেদিন আমার দাদু যদি ঠাকুমার কথায় ভিটেটাকেই আঁকড়ে ধরে বসে থাকতেন তবে তুলসী তলায় প্রদীপ দিতে না পেলেও ভিটে-বাটি সমস্ত কিছু অবশ্যই থাকতো একটা শর্তের বিনিময়ে- ধর্ম আর ইজ্জত ত্যাগ। কিন্ত তবুও আমার দাদু তাঁর প্রিয় ভিটে বা "দ্যাশে" থাকার জন্য এতটুকু ত্যাগ শিকার করলেন না। ধর্ম আর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে চলে এলেন এদেশে।

কিন্তু কী হবে দ্যাশ নিয়ে হাহুতাশ করে? যা গেছে তা যাক। ক্ষতবিক্ষত হৃদয় উদারতায় শান্তি পাক। তারচেয়ে বরং পদ্মার ইলিশ নিয়ে কথা বলি। আবারো তো কোনো একদিন বাংলা ছেড়ে যেতে হবে, যেতে হবে ভারতবর্ষ ছেড়ে। সেদিন চাইলেও আমি আমার ভারত মাকে বুকে আগলে ধরে রাখতে পারবো না। যেতেই হবে। ধর্ম বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় নিতে হবে আবারো কোনো দেশে। আবারো তাকে মা বলে ডাকতে হবে। আমার মায়ের কাছে এই দেশেই থাকা সম্ভব হবে, যদি আমি আমার স্বাতন্ত্রকে জলাজ্ঞলি দিয়ে অন্য ধর্ম কে আপন করে নিই। কিন্ত আমি কি পারবো, নিজের ধর্ম ছেড়ে ভারতমায়ের সেবা করতে? সেদিন কি সত্যিই আমার মাকে ছেড়ে, মায়ের সাথে বেইমানি করে, ধর্ম বাঁচানোর তাগিদে রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে পালাতে হবে না?
সেদিন আবারো নতুন কোনো দেশে বসে নাতি-নাতনিদের নতুন নতুন গল্প শোনাবো, "আমাগো একখান দ্যাশ ছিল..."

Popular posts from this blog

খাদ্যের আমিষ-নিরামিষ🌰 🧄

  আণবিক জীববিজ্ঞানের  দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষ বা প্রোটিন হল পেপটাইড বন্ধনসমূহ দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের  পলিমার  শৃঙ্খল। মানব পরিপাকের সময় পাকস্থলীতে  হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড   ও   প্রোটিয়েজ   নামক   উৎসেচকের  ক্রিয়ার ফলে আমিষ অণুগুলো ভেঙে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর  পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে  পরিণত হয়। মানবদেহ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো  জৈবসংশ্লেষ  করতে পারে না, তাই খাদ্য হিসেবে গৃহীত আমিষে অবস্থিত এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো  শোষণ  হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমিষ মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান। এটি দেহকলার গাঠনিক উপাদানগুলোর একটি এবং জ্বালানির উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। জ্বালানি হিসেবে আমিষ শর্করার সমপরিমাণ শক্তি ঘনত্ব প্রদান করে: প্রতি গ্রামে ৪ কিলোক্যালরি (১৭ কিলোজুল)। এর বিপরীতে স্নেহপদার্থ বা চর্বি প্রতি গ্রামে ৯ কিলোক্যালরি বা ৩৭ কিলোজুল শক্তি প্রদান করে। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সংজ্ঞাসূ...

Dashavatar : 10 Avatars of Bhagwan Vishnu!

1. Matsya Avatar 2. Kurma Avatar 3. Varaha Avatar 4. Narasimha Avatar 5. Vamana Avatar 6. Parashurama Avatar 7. Shree Ram Avatar 8. Shri Krishna Avatar 9. Balarama Avatar 10. Kalki Avatar

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? ক...