Skip to main content

রামচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে সীতার কি অযোধ্যা রাজত্ব করার সম্ভাবনা ছিল?

আমরা জানি বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে কৈকেয়ী দশরথের কাছে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন - রামচন্দ্রের স্থলে ভরত অযোধ্যার রাজা হবেন এবং দশরথ তার প্রিয় পুত্রকে অরণ্যে নির্বাসনে পাঠাবেন।
আমরা এও জানি যে কৈকেয়ীর কর্কশ বাক্য শুনে দশরথের মানসিক অবস্থা কি দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রামচন্দ্র নির্বিকার, তিনি পিতার সায়েই কৈকেয়ীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি পিতাজ্ঞা পালন করব, আপনি চিন্তা করবেন না। পিতা রাজি না থাকলেও মাতার আদেশ পেলেও চলবে। আপনার আদেশ পালন করে আমি আজই চৌদ্দ বৎসরের জন্য অরণ্যে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করব। আমার অনুপস্থিতিতে ভরত রাজসিংহাসনে বসবেন।”

এই কথা শুনে দশরথ মূর্ছা গেলেন, লক্ষ্মণ সৎমা কৈকেয়ীর ওপর যারপরনাই অসন্তুষ্ট হলেন। রামচন্দ্রের মাতা কৌশল্যা অত্যন্ত দুঃখী হয়ে পড়লেন। তখন সীতা রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে বললেন, "স্বামী, আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনার সাথে যাব এবং চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনবাসী হব।” এই বলে সীতা জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন – যাত্রার জন্য শুভ মুহূর্ত কি হবে।

রামচন্দ্র তখন তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজপ্রাসাদেই থাকতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সীতা সে অনুরোধে যখন কর্ণপাত করলেন না তখন রামচন্দ্র বললেন, “আমি সংসারের সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করছি, আমি রাজকীয় সব কিছুই ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর উপযুক্ত বস্ত্র ধারণ করছি। তুমিও তাই করো।” শুনে সীতা প্রস্তুত হতে লাগলেন।

খনিত্র পিটকে চ উভে মম আনয়ত গচ্ছতঃ |
চতুর দশ বনে বাসম বর্ষাণি বসতঃ মম || ২-৩৭-৫

বঙ্গানুবাদ: তখন রামচন্দ্র পিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “পিতা আমি বনবাসে যাচ্ছি, কেউ আমাকে অরণ্যবাসের উপযুক্ত চীরবস্ত্র, খনিত্র ও পেটক এনে দিক।”

অথ চীরাণি কৈকেয়ী স্বয়ম আহৃত্য রাঘবম |
উবাচ পরিধত্ত্ব ইতি জন ওঘে নিরপত্রপা || ২-৩৭-৬

বঙ্গানুবাদ : রামচন্দ্রের বাক্য শ্রবন করা মাত্র কৈকেয়ী স্বয়ং উপরোক্ত বস্তু এনে নির্লজ্জের মতন রামচন্দ্রকে বললেন, “রাম! আমি এই চীরবস্ত্র এনে দিলাম, তুমি এগুলো পরিধান করো।”

স চীরে পুরুষ ব্যাঘ্রঃ কৈকেয়য়াঃ প্রতিগৃহ্য তে | 
সূক্ষ্ম বস্ত্রম অবক্ষিপ্য মুনি বস্ত্রাণি অবম্ভ হ || ২-৩৭-৭

বঙ্গানুবাদ : রামচন্দ্র বিলম্ব না করে নিজ বস্ত্র পরিত্যাগ করে কৈকেয়ীর দেওয়া চীরবস্ত্র পরিধান করলেন। রামচন্দ্র বাঘের ছাল কাঁধে তুলে নিলেন।

লক্ষ্মণও পিতার সম্মুখে তাপস বেশ ধারণ করলেন। তখন সীতা চীরবস্ত্র হাতে নিয়ে কৈকেয়ীর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন, যেন হরিণের সামনে বাঘ দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর রামচন্দ্রের দিকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "বনবাসী ঋষিগণ কিভাবে বস্ত্র পরিধান করেন?” এই বলে সীতা এক খণ্ড বস্ত্ৰ গলায়, অপর খণ্ড হাতে নিয়ে লজ্জিত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন রামচন্দ্র তার কৌষেয় বস্ত্রের ওপরেই চীরবস্তু পরিয়ে দিলেন।

ঐ সময়ে সেখানে উপস্থিত লোকজন আর্তস্বরে বললেন, "সীতাকে বনে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, উনি অযোধ্যাতেই থাকুন।” তখন কুলগুরু বশিষ্ঠ অত্যন্ত কুপিত ভাবে কৈকেয়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন-

অতিপ্রবৃত্তে দুর্যেধে কৈকেয়ি কুলপাংসনি | 
বঞ্চিত্বা চ রাজানম ন প্রমাণেঽবতিষ্ঠসে || ২-৩৭-২২

বঙ্গানুবাদ : “দুঃশীলা কৈকেয়ী! রাজাকে প্রবঞ্চনা করে তোমার সাহস অতিশয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তুমি কূলের নামে কালিমা লেপন করেছ!” 

ন গন্তব্যম বনম দেব্যা সীতায়া শীলবর্জিতে |
অনুষ্ঠায়তি রামস্য সীতা প্রকৃতমাসনম || ২-৩৭-২৩

বঙ্গানুবাদ : “শুনে রাখো, সীতা বনবাসী হবেন না। তিনি রামচন্দ্রের স্থলাভিষিক্ত হবেন, অযোধ্যার শাসক হবেন।”

আত্মা হি দারাঃ সর্বেষাম দারস গ্রহবর্তিনাম | 
আত্মেয়মিতি রামস্য পালয়িষ্যতি মেদিনীম || ২-৩৭-২৪

বঙ্গানুবাদ : যেহেতু সীতা রামচন্দ্রের ভার্যা, তাই তিনি রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গ। সুতরাং সীতা রামচন্দ্রের প্রতিভূ হয়ে অযোধ্যা শাসন করতেই পারেন।

একটু থেমে বশিষ্ঠ বললেন, “যদি সীতা প্রকৃতই রামচন্দ্রের সহচারিণী হন, তবে নিশ্চয়ই তিনি স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে অরণ্যচারী হবেন। সেক্ষেত্রে আমরাও আর অযোধ্যায় থাকব না, তারা যেখানে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব। আশা করি ভরত ও শত্রুঘ্নও দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অরণ্যচারী হবেন, চীরবস্ত্র ধারণ করে। অতঃপর এই রাজ্য নির্জন, জনমানববর্জিত রাজ্যে রূপান্তরিত হবে। রামচন্দ্র যে অরণ্যে থাকবেন, সেটাই হবে তার রাজ্য।”

অতঃপর কৈকেয়ীর দিকে তাকিয়ে বশিষ্ঠ বললেন, “তুমি বুঝতে পারছ কি, পুত্রের মঙ্গল করতে গিয়ে কীভাবে আসলে তার অমঙ্গলই করছ? রামচন্দ্রের পক্ষে শুধু মানুষ নয়, এমনকি পশু-পক্ষীও আছে। আজই দেখতে পাবেন যখন রামচন্দ্র সদলবলে অরন্যের দিকে যাবেন, তখন অযোধ্যা প্রাণী, পক্ষীশূন্য রাজ্যে পরিণত হবে।”

তারপর বশিষ্ঠ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কৈকেয়ীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “যাও, তুমি এর গা থেকে চীরবস্ত্র অপসারণ করে পাটরানীর উপযুক্ত বস্ত্র পরিধান করিয়ে দাও। চীরবস্ত্র সীতার জন্য নয়।"

তখন সীতা বশিষ্ঠকে বললেন, “আমি স্বামী যেখানে যাবেন, সেখানেই আমি যাব। আমি রাজরানী সেজে অযোধ্যা শাসন করতে পারব না।”

বশিষ্ঠের তিরস্কার বাণী থেকে বোঝা যায় রামায়ণ যুগে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রাজ্যের শাসক হতে পারতেন।

: Ayan Milosevic Chakraborty

Popular posts from this blog

 বর্তমানে রাত্রীকালীন বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা :- ____________________________________ মুসলমান অত্যাচারের কারণে 'রাত্রি কালীন গোপন বিবাহ' রীতির প্রচলন। এসব সত্য জানার সত্ত্বেও এখনও এই রীতি বয়ে নিয়ে হচ্ছে। তার সম্ভাব্য কারণ কি কি হতে পারে? ১| দিনের বেলা সকলে ব্যস্ত থাকে নানা কাজে। কেও স্কুলে, কেও অফিসে কেও বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকেন। তাই সেই কাজের মাঝে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই সন্ধ্যার লগ্নে বিয়ে হলে মানুষ দুপুরে কাজের শেষে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যেয় সেজেগুজে এসে বিয়ে দেখতে পারে। রাত্রে প্রায় সকলেই বাড়িতে থাকেন। তাই কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করা বিষয়টা অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাট মনে হয়। ২| এখন বিবাহ একটি পারিবারিক উৎসব নয়। বরং বিবাহ আত্ম অহংকার, ক্ষমতার প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। রাতে জমকালো Light Show দেখানো যায়। বাজীর প্রদর্শনী করা যায়। এর সাথে আরও যত রকমভাবে নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন করা সম্ভব সবরকম চেষ্টাই করা হয়। কিন্ত দিনে এই সমস্ত ঘটনার Prime Focus একজনের উপর পড়া সম্ভব নয়, তাই রাত্রে। ৩| সামাজিক দৃষ্টিকোণ: বর্তমানে দিনে বিবাহ দেওয়াকে দারিদ্রতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ...

ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার তত্ত্বের Propaganda Vs Reality

ভারত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলে প্রায় 50 কোটি মুসলিম বাস করে। কিন্তু, এতো মুসলিম তো আরবেও নেই। তাহলে এতো মুসলমান এলো কোথা থেকে? অন্য ধর্মের লোক এতো দ্রুত হারে বাড়ছে না কেনো? অন্য ধর্মের 50 কোটি লোক হলোনা কেনো ? Communist আর secular দের বক্তব্য এরা হিন্দুই ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে আর মুসলিমদের ধর্মের উদারতার কারণে জাত-পাতহীনতার কারণে এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এরা মুসলিমদের দান-ধ্যানের নীতি, সুফি_সন্তদের জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়ে "ইসলাম" ধর্ম গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার তত্ত্ব  Communist রা হিন্দু সমাজকে দুইভাগে ভাগ করেন-- 1. উচ্চ বর্ণ  2. নিম্ন বর্ণ সমাজের সবচেয়ে ভক্তিবান মানুষ হলো তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষরা। তাদের কাছে ধর্মই সব। তাঁরা সব করতে পারেন কিন্তু ঠাকুর কে অবহেলা করেন না। তাঁরা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের জন্যেই ধর্মান্তরিত হয়েছে এটা বিশ্বাস করেন কিভাবে❓ এটা তো গেলো পুরোনো যুগের কথা.... এবার এখনকার কথা বলি.... আচ্ছা বলুন তো, আমরা আমাদের পারিবারিক সূত্রে বা বন্ধুদের সূত্রে প্রায় প্রতিদিন নানান রকম খবর শুনি। যেমন- কারোর বিয়ে হয়েছে, কার...

বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথালয় এর সংযুক্তিকরণ

আমি কিছু ছোট ছোট old age home এবং orphan home এ গেছি এবং সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে বৃদ্ধ মানুষগুলো তাঁদের পরিবারের ছোটো-ছোটো নাতি-নাতনীদের মিস করেন। আবার অনাথালয়ের orphan দের কাছে গিয়ে মনে হয়েছে তারা যদি দাদু ঠাকুমাদের মত কাওকে পেত, যারা তাদের একটু গল্প বলবে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের আদর করবে তাহলে তারাও হয়ত অনেকটা ভালো থাকত। তাই আমার মনে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম ও orphan home যদি একই ছাদের নীচে করা সম্ভব হয় তাহলে ওইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার যে কষ্ট, সেটা সামান্য হলেও লাঘব হবে। এবার আমি এটা নিয়ে কতটা ঠিক ভেবেছি বা এটা ইমপ্লিমেন্ট করা কতটা সম্ভব বা তার প্রতিবন্ধকতার জায়গা গুলো আমি সম্পুর্ন ওয়াকিবহল নই। সম্পূর্ণ একটা ইমোশনাল ভাবনা থেকে এটা আমি ম্যাডামকে জানিয়েছি। ম্যাডাম বা ডিপার্টমেন্ট এ যারা দীর্ঘদিন ধরে অনেক গুরুদায়িত্ব সামলেছেন তাঁদের সবার পর্বত সমান অভিজ্ঞতা। যদি তাঁরা এই ভাবনার মধ্যে কোনো পজিটিভ দিক আছে বলে মনে করেন এবং প্রাকটিক্যাল গ্রাউন্ডে এটা ইমপ্লিমেন্ট করা সম্ভব মনে করেন এবং এক ছাদের তলায় old age home এবং orphan home তৈরী করা...