Skip to main content

স্বাধীনতার নায়করা পর্ব ~ ৭

 || আন্দামানের ইন্দু ||


প্রতি বছরই বহু বাঙালি ঘুরতে যান এই আন্দামানে আর আন্দামানে বেড়াতে গেলে আন্দামান সেলুলার জেল দর্শন করতে যান প্রায় সকলেই মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে দেখতে পাবেন শহীদ পার্ক | আর সেখানেই আছে ছয় জন বিপ্লবীর ভাস্কর মূর্তি একটি মূর্তির নীচে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা আছে ইন্দুভূষণ রায়|


তা কে এই ইন্দুভূষণ ? কি তাঁর পরিচয় ? আসুন পিছিয়ে যাই প্রায় একশো দশ বছর...


বাইশ বছরের ছেলে নাম ইন্দুভূষণ রায় আলিপুর বোমা মামলায় সাজা পেয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে এসেছে | নির্দয় ব্রিটিশ জেলার তাঁকে কাজ দিল জঙ্গলে | কঠিন কাজ | জঙ্গলে এক বিশেষ ধরণের আন্দামানি গাছ আছে, সেই গাছের ছাল ছাড়িয়ে আঁশ বের করতে হবে| গাছের আঁঠার বিষে কয়েকদিনের মধ্যেই দুই হাতে ঘা হল ইন্দুভূষণের তবুও ছাড় পেলেন না | একদিন জমাদারকে বললেন অন্যদের মত তাঁকেও জেলের ভিতরের কাজ দিতে রাজি হলেন জমাদার ইন্দুভূষণের হাতে পায়ে বেড়ি পড়ানো হল| কাজ দেওয়া হল জেলের ভিতরে খানিকটা খুশি হল ইন্দুভূষণ | জেলের ভিতর অন্তত পরিচিত কিছু মুখ দেখা যাবে|


দুদিন পরেই আবার হুকুম এল ইন্দুভূষণকে জঙ্গলে গিয়েই কাজ করতে হবে এবার বেঁকে বসলেন ইন্দু | কিন্তু কেই বা শুনবে ? জেলার আরও কঠিন শাস্তি দিলেন | আগের চেয়েও দ্বিগুণ কাজ জঙ্গলে গিয়ে করতে হবে এই আদেশ এল | ইন্দুভূষণ কয়েকদিন জঙ্গলে কাজ করলেন | দুই হাতের বিষাক্ত ঘা ভয়াবহ আকার নিল জেলারকে গিয়ে ইন্দুভূষণ বললেন তাঁকে অন্য কাজ দিতে জেলার রাজি হলেন না | ইন্দুভূষণ হাত দেখিয়ে বললেন, ঘায়ের জন্যে ডান হাত দিয়ে ভাত খেতেও পারছি না জেলার হাতের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, বাঁ হাত দিয়ে খাও ইন্দুভূষণ বাঁ হাত দেখিয়ে বললেন, বাঁ হাতেও ঘা ভরে গেছে, কয়েকদিনের জন্যে আপনি আমাকে অন্য কাজ দিন, ঘা ঠিক হয়ে গেলে আবার জঙ্গলের কাজ দেবেন | ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে জেলার বলে, ঠিক আছে অন্য কাজ দিচ্ছি, কাল থেকে ঘানি টানবে | ইন্দুভূষণের চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে | কাতর হয়ে জেলারকে অনুরোধ করে, স্যার এই হাত দিয়ে ঘানি টানা সম্ভব না, যন্ত্রনায় মরে যাব এসব বাজে আবেদনে কান দিতে চায় না জেলার হুকুম হুকুম ইন্দুভূষণ বুঝতে পারল তাঁর আবেদন কেউ শুনবে না |


এই যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব | দিনটা ছিল ১৯১২ সালের ৯ এপ্রিল ঐদিন রাতে সেলের নির্জন কুঠুরির অন্ধকারে ইন্দুভূষণ নিজের গায়ের কুর্তাটা টান দিয়ে ছিড়ে ফেলল | সেই কাপড় গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা করে ইন্দুভূষণ রায় |


ইন্দ্রভূষণ রায়ের জন্ম ১৮৯০ সালে খুলনায় | স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করায় তাঁকে নাকি বিয়ে দিয়ে সংসারের জোয়ালে বাঁধার তোড়জোড় হচ্ছিল | আধ্যাত্মিক প্রকৃতির বন্ধনভীর ইদু কলকাতায় চলে যান | সেখানে আলাপ হয় বারীন ঘোষের সঙ্গে বারীন ঘোষ তাঁকে মানিকতলার বাগান বাড়িতে নিয়ে যান। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন ইন্দু | সেই সময় ফরাসী অধিকৃত চন্দননগর বিপ্লবীদের অস্ত্র সংগ্রহের একটি প্রধান উৎসস্থল ছিল | 


তৎকালীন মেয়র সেই উৎসটি বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল বারীন ঘোষ ইন্দুভূষণকে দায়িত্ব দেন ওই মেয়রকে হত্যা করার ইন্দুভূষণ মেয়রের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে | ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মেয়র | পালিয়ে যান ইন্দুভূষণ | পরবর্তীতে বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হন ইন্দুভূষণ রায় দশ বছর দীপান্তরের সাজা হয় তাঁর | আন্দামান সেলুলার জেলেই ব্রিটিশদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেন এই বিপ্লবী সেলুলার জেলে মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে শহীদ পার্কে যে ছয় বিপ্লবীর ভাস্কর মূর্তি রয়েছে, তারা সবাই এই কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন | এই ছয় এই ছয়জন হলেন পণ্ডিত রামরাখা, মহাবীর সিংহ, পণ্ডিত পরমানন্দ, মোহিত মৈত্র, মোহন কিশোর নমোদাস এবং ইন্দুভূষণ রায় স্বাধীনতার ৫০ তম বর্ষপূর্তিতে রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন মূর্তি গুলির আবরণ উন্মোচন করেন|


ইতিহাসের পাতায় জায়গা হয়নি ইন্দুভূষণ রায়ের সেলুলার জেলের ইন্দুভূষণ রায়ের মর্মর মূর্তিটি হয়ত অনেক কথা বলতে চায় বাঙালি কি সেই কথা শুনতে পায়..?

মহান বিপ্লবীকে আমাদের প্রণাম...

ইন্দুভূষণ রায়


তথ্যসূত্রঃ উদ্ধত খড়গ (অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত)

© এক যে ছিলো নেতা

Popular posts from this blog

দাড়িভিটের স্ফুলিঙ্গ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রদীপ জ্বালাতে আমরা ব্যর্থ

এসো হে সেপ্টেম্বর, আমার ভাষার মাস। ভাষাতীর্থ দাড়িভিট, রাজেশ তাপসের বাস।। ২০১৮-র ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার দাড়িভিট হাইস্কুলের গুলি চালনার ঘটনা এখন সবাই জানেন। আলোচনার সুবিধার জন্য অল্পকথায় প্রেক্ষাপটটা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক। দাড়িভিট হাইস্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ছিল বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের। এই স্কুলে উর্দুভাষী ছাত্র-ছাত্রী নেই। স্থানীয়রা মুসলমান। তৃণমূল নেতার তৎপরতায় সরকারের বিদ্যালয় দপ্তর পাঠালো বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষকের জায়গায় উর্দু শিক্ষক এবং সংস্কৃত শিক্ষক। অবাঞ্ছিত উর্দু শিক্ষকের নিয়োগকে একটু সহনশীল করার জন্য সম্ভবত সংস্কৃত শিক্ষককের নামটাও যুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্ররা মানেনি, প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীরা। অতএব পুলিশ সামান্য উত্তেজনাতেই গুলি চালায়, ফলে দুই প্রাক্তন ছাত্র রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মণের মৃত্যু হয়। এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তাহখানেক উত্তাল হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন এবিভিপি মিছিল মিটিং করে। বিজেপি ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বন ডাকে যা আংশিক সফল হয়। এই বনধকে সফল করতে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির যুবমোর্চার সভাপতি দেবজিৎ সরকার দাড়িভিট গেল...

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? ক...