|| আন্দামানের ইন্দু ||
প্রতি বছরই বহু বাঙালি ঘুরতে যান এই আন্দামানে আর আন্দামানে বেড়াতে গেলে আন্দামান সেলুলার জেল দর্শন করতে যান প্রায় সকলেই মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে দেখতে পাবেন শহীদ পার্ক | আর সেখানেই আছে ছয় জন বিপ্লবীর ভাস্কর মূর্তি একটি মূর্তির নীচে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা আছে ইন্দুভূষণ রায়|
তা কে এই ইন্দুভূষণ ? কি তাঁর পরিচয় ? আসুন পিছিয়ে যাই প্রায় একশো দশ বছর...
বাইশ বছরের ছেলে নাম ইন্দুভূষণ রায় আলিপুর বোমা মামলায় সাজা পেয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে এসেছে | নির্দয় ব্রিটিশ জেলার তাঁকে কাজ দিল জঙ্গলে | কঠিন কাজ | জঙ্গলে এক বিশেষ ধরণের আন্দামানি গাছ আছে, সেই গাছের ছাল ছাড়িয়ে আঁশ বের করতে হবে| গাছের আঁঠার বিষে কয়েকদিনের মধ্যেই দুই হাতে ঘা হল ইন্দুভূষণের তবুও ছাড় পেলেন না | একদিন জমাদারকে বললেন অন্যদের মত তাঁকেও জেলের ভিতরের কাজ দিতে রাজি হলেন জমাদার ইন্দুভূষণের হাতে পায়ে বেড়ি পড়ানো হল| কাজ দেওয়া হল জেলের ভিতরে খানিকটা খুশি হল ইন্দুভূষণ | জেলের ভিতর অন্তত পরিচিত কিছু মুখ দেখা যাবে|
দুদিন পরেই আবার হুকুম এল ইন্দুভূষণকে জঙ্গলে গিয়েই কাজ করতে হবে এবার বেঁকে বসলেন ইন্দু | কিন্তু কেই বা শুনবে ? জেলার আরও কঠিন শাস্তি দিলেন | আগের চেয়েও দ্বিগুণ কাজ জঙ্গলে গিয়ে করতে হবে এই আদেশ এল | ইন্দুভূষণ কয়েকদিন জঙ্গলে কাজ করলেন | দুই হাতের বিষাক্ত ঘা ভয়াবহ আকার নিল জেলারকে গিয়ে ইন্দুভূষণ বললেন তাঁকে অন্য কাজ দিতে জেলার রাজি হলেন না | ইন্দুভূষণ হাত দেখিয়ে বললেন, ঘায়ের জন্যে ডান হাত দিয়ে ভাত খেতেও পারছি না জেলার হাতের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, বাঁ হাত দিয়ে খাও ইন্দুভূষণ বাঁ হাত দেখিয়ে বললেন, বাঁ হাতেও ঘা ভরে গেছে, কয়েকদিনের জন্যে আপনি আমাকে অন্য কাজ দিন, ঘা ঠিক হয়ে গেলে আবার জঙ্গলের কাজ দেবেন | ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে জেলার বলে, ঠিক আছে অন্য কাজ দিচ্ছি, কাল থেকে ঘানি টানবে | ইন্দুভূষণের চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে | কাতর হয়ে জেলারকে অনুরোধ করে, স্যার এই হাত দিয়ে ঘানি টানা সম্ভব না, যন্ত্রনায় মরে যাব এসব বাজে আবেদনে কান দিতে চায় না জেলার হুকুম হুকুম ইন্দুভূষণ বুঝতে পারল তাঁর আবেদন কেউ শুনবে না |
এই যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব | দিনটা ছিল ১৯১২ সালের ৯ এপ্রিল ঐদিন রাতে সেলের নির্জন কুঠুরির অন্ধকারে ইন্দুভূষণ নিজের গায়ের কুর্তাটা টান দিয়ে ছিড়ে ফেলল | সেই কাপড় গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা করে ইন্দুভূষণ রায় |
ইন্দ্রভূষণ রায়ের জন্ম ১৮৯০ সালে খুলনায় | স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করায় তাঁকে নাকি বিয়ে দিয়ে সংসারের জোয়ালে বাঁধার তোড়জোড় হচ্ছিল | আধ্যাত্মিক প্রকৃতির বন্ধনভীর ইদু কলকাতায় চলে যান | সেখানে আলাপ হয় বারীন ঘোষের সঙ্গে বারীন ঘোষ তাঁকে মানিকতলার বাগান বাড়িতে নিয়ে যান। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন ইন্দু | সেই সময় ফরাসী অধিকৃত চন্দননগর বিপ্লবীদের অস্ত্র সংগ্রহের একটি প্রধান উৎসস্থল ছিল |
তৎকালীন মেয়র সেই উৎসটি বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল বারীন ঘোষ ইন্দুভূষণকে দায়িত্ব দেন ওই মেয়রকে হত্যা করার ইন্দুভূষণ মেয়রের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে | ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মেয়র | পালিয়ে যান ইন্দুভূষণ | পরবর্তীতে বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হন ইন্দুভূষণ রায় দশ বছর দীপান্তরের সাজা হয় তাঁর | আন্দামান সেলুলার জেলেই ব্রিটিশদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেন এই বিপ্লবী সেলুলার জেলে মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে শহীদ পার্কে যে ছয় বিপ্লবীর ভাস্কর মূর্তি রয়েছে, তারা সবাই এই কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন | এই ছয় এই ছয়জন হলেন পণ্ডিত রামরাখা, মহাবীর সিংহ, পণ্ডিত পরমানন্দ, মোহিত মৈত্র, মোহন কিশোর নমোদাস এবং ইন্দুভূষণ রায় স্বাধীনতার ৫০ তম বর্ষপূর্তিতে রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন মূর্তি গুলির আবরণ উন্মোচন করেন|
ইতিহাসের পাতায় জায়গা হয়নি ইন্দুভূষণ রায়ের সেলুলার জেলের ইন্দুভূষণ রায়ের মর্মর মূর্তিটি হয়ত অনেক কথা বলতে চায় বাঙালি কি সেই কথা শুনতে পায়..?
মহান বিপ্লবীকে আমাদের প্রণাম...
ইন্দুভূষণ রায় |
তথ্যসূত্রঃ উদ্ধত খড়গ (অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত)
© এক যে ছিলো নেতা