Skip to main content

খাদ্যের আমিষ-নিরামিষ🌰 🧄

 আণবিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষ বা প্রোটিন হল পেপটাইড বন্ধনসমূহ দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার শৃঙ্খল। মানব পরিপাকের সময় পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড  ও  প্রোটিয়েজ  নামক  উৎসেচকের ক্রিয়ার ফলে আমিষ অণুগুলো ভেঙে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে পরিণত হয়। মানবদেহ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো জৈবসংশ্লেষ করতে পারে না, তাই খাদ্য হিসেবে গৃহীত আমিষে অবস্থিত এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো শোষণ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমিষ মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান। এটি দেহকলার গাঠনিক উপাদানগুলোর একটি এবং জ্বালানির উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। জ্বালানি হিসেবে আমিষ শর্করার সমপরিমাণ শক্তি ঘনত্ব প্রদান করে: প্রতি গ্রামে ৪ কিলোক্যালরি (১৭ কিলোজুল)। এর বিপরীতে স্নেহপদার্থ বা চর্বি প্রতি গ্রামে ৯ কিলোক্যালরি বা ৩৭ কিলোজুল শক্তি প্রদান করে। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সংজ্ঞাসূচক বৈশিষ্ট্য হল এর ভেতরে অ্যামিনো অ্যাসিডসমূহের সংযুক্তি।


এখন প্রশ্ন, পেঁয়াজ আমিষ না নিরামিষ? 

আসলে আমিষ বলতে বোঝায় প্রোটিন। যেহেতু মাছ-মাংস রান্নার ক্ষেত্রে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয় তাই অনেকেই মনে করে থাকেন এটি আসলে একটি আমিষ খাবার। যেহেতু, মাছ, মাংস, ডিম রান্নার ক্ষেত্রে পেঁয়াজ ব্যবহার করতেই হয় তাই কোনো ধর্মীয় রান্নাতে তাই এই সবজিকে ব্যবহার করা হয় না। অনেকে আবার এটিকে আমিষ বলে মানেন।

পিয়াঁজ ও রসুন কে আমিষ ধরে নেওয়া হল কিভাবে? সমস্ত সব্জির মধ্যে হঠাৎ পিয়াঁজ রসুন কি এমন দোষ করল, যাতে এদের নিরামিষ তকমা কেড়ে নিয়ে আমিষ হিসেবে গণ্য করা শুরু হল।

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। আয়ুর্বেদ অনুযায়ী খাদ্যকেও এই 'ত্রিগুণ' অর্থাৎ এই তিনটি গুণ অনুসারে ভাগ করা হয়েছে। যথা- রাজসিক, সাত্ত্বিক ও তামসিক।

সাত্ত্বিক বলতে মূলতঃ নিরামিষ শাক সবজি জাতীয় খাবারের কথাই বোঝায়। যেমন- ধান, গম, শশা, শাক, চিনি, ঘি, দারুচিনি, আখরোট ইত্যাদি।

রাজসিক বলতে মূলতঃ সেইসব খাবার বোঝায় যেগুলি অত্যন্ত উগ্র গন্ধ উদ্রেককারী, নোনতা কিংবা তেতো স্বাদের হয় ।

আর তামসিক হল বাসি বা ঠান্ডা করা খাবার, অর্ধ সেদ্ধ, মাছ, মাংস, ডিম তথা আমিষ জাতীয় খাদ্য, মদ ইত্যাদি।

প্রাচীন আয়ুর্বেদ অনুযায়ী চরিত্রগত কারণে যেহেতু পিয়াঁজ ও রসুনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আছে, তাই এগুলি রাজসিক খাদ্যের মধ্যে পড়ে। যেহেতু রাজসিক খাদ্য, রাজা গুণকে জাগিয়ে তোলে, যা কিনা মানুষের মনে ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার, প্রচারমুখীতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও জাগতিক সুখভোগের ইচ্ছা বাড়িয়ে তোলে তাই এই ধরনের খাবার না খাওয়াই উচিত। মনের আধ্যাত্মিক উন্নতি চাইলে রাজসিক খাবার নৈব নৈব চঃ।

বিখ্যাত আয়ুর্বেদ পন্ডিত Dr. Robert E. Svoboda এর যতে পিয়াজ ও রসুন খেলে মনে জাগতিক চিন্তা বড় প্রবল হয়ে ওঠে। যেহেতু আত্মার মুক্তি পেতে জাগতিক চিন্তার প্রতি মোহভঙ্গ সবার আগে দরকার তাই পিয়াঁজ ও রসুন পরিকল্পিতভাবে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ করা হয়।

আমিষ হিসেবে পিয়াঁজ রসুনের অন্তর্ভুক্তি ও খাদ্যরূপে নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ আছে। পিয়াজ ও রসুন দুইই আ্যলিয়াম শ্রেণীভুক্ত হওয়ার কারণে এই দুইয়ের মধ্যে ভীষণ ভাবে ফেনোলিক ফাইটোকেমিক্যাল উপস্থিত যা কিনা মানুষের শরীরে অ্যানড্রোজেনিক, অর্থাৎ যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। আয়ুর্বেদ মতে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে, বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণে এই দুটি, অর্থাৎ পিয়াঁজ ও রসুন ব্যবহার হয়। এগুলো খেলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম সরাসরি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এখন এই কামনা বাসনা যেহেতু মানব মনের তামসিক প্রবৃত্তির মধ্যে পড়ে, তাই আত্মার শুদ্ধির প্রয়োজনেই এগুলি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।

'মনু সংহিতা'-য় মনু সমগ্র মানবজাতিকে পিয়াঁজ ও রসুনকে খাদ্যরূপে গ্রহণে মানা করেন। উনি যেসব যুক্তি দেন তার বক্তব্যের সমর্থনে তার মধ্যে অন্যতম হল পিয়াজ ও রসুন যেহেতু মাটিতে জন্মায়, যা কিনা অশুদ্ধ, তাই পুনর্জাত মানুষের এগুলো গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই উচিত। মনুর মতে, পুনর্জাত মানুষ যদি মাশরুম, শূয়োর, রসুন, মোরগ, পিয়াঁজ ও পিয়াঁজপাতা এই ছয়টির যেকোন একটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে তাকে 'কৃক্ষরা' বা 'কান্দ্ৰায়ন' কৃচ্ছসাধন করতে হবে। অর্থাৎ যা কিনা একরাত্রি পূর্ন উপবাস বোঝায়।এটিই হল তার প্রায়শ্চিত্ত।

আবার প্রচলিত এক কিংবদন্তি অনুসারে সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ্ণু যখন তার মোহিনী রূপ ধারণ করে দেবতাদের মধ্যে অমৃত বিতরণ করছিলেন তখন দেবতাদের সারিতে রাহু ও কেতু এই দুই অসুর দাঁড়িয়েছিল। বিষ্ণু খেয়াল না করে তাদের ও অমৃতের ভাগ দিয়ে ফেলেন। পরে খেয়াল হতেই রাহু ও কেতুর মাথা এক কোপে কেটে ফেলেন। মাথা যখন কাটছেন বিষ্ণু, তখনও রাহু কেতু'র গলা দিয়ে অমৃত নামেনি। মুণ্ডচ্ছেদের ফলে সেই অমৃত গলা হয়ে মাটিতে পড়ে এবং সেখান থেকে জন্ম নেয় পিয়াজ ও রসুন। যেহেতু পিয়াজ রসুন অসুরের গলাধঃকৃত অমৃত থেকে জাত সেহেতু এগুলি গ্রহণে মানব দেহে আসুরিক শক্তির আবির্ভাব হবে সুতরাং এগুলি গ্ৰহণ থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।

কেবল সনাতন হিন্দু ধর্মই নয়, খাবার পাতে পিঁয়াজ রসুনের বিপক্ষে মতদান করেছে বৈষ্ণবরাও। বৈষ্ণব ধর্মেও পিয়াঁজ ও রসুনের বিপক্ষেই যাবতীয় ধারণা, গল্প ও নিয়ম জন্ম নিয়েছে।

জৈন ধর্মেও পিয়াজ ও রসুনকে আমিষ হিসেবেই বিবেচিত করা হয়েছে। জৈনরা যেহেতু অহিংস ধর্মের প্রচারক ও প্রবর্তক সেহেতু তারা প্রাত্যহিক জীবনে যথা সম্ভব প্রাণীদেহে আঘাত বা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। এই অহিংসা নীতি একইভাবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জৈনদের মেনে চলা কঠোর অনুশাসনের মধ্যে পড়ে মূলজ উদ্ভিদ না খাওয়া। মূলজ উদ্ভিদ যেমন- আলু, পিয়াজ, রসুন, গাজর ইত্যাদি। জৈন ধর্মানুযায়ী এই সব মূলজ উদ্ভিদ “অনান্থকায়“। অনান্থকায় বলতে বোঝায় এক দেহ, কিন্তু অফুরান,অনন্ত প্রাণ। মূলজ উদ্ভিদ যেমন, পিয়াঁজ যদিও বাইরে থেকে দেখে মনে হয় একটাই মূল অংশ, কিন্তু খোসা ছাড়ানোর পর বোঝা এটি অনেক প্রাণের মিলনস্থল। এই ক্ষুদ্র প্রাণ আঘাত পায় যখন একে মাটি থেকে তুলে নেওয়া হয়, উপড়ে নেওয়া হয়। যেহেতু এর মধ্যে থাকা চক্ষু (bulb), যা কিনা পিয়াঁজের সবথেকে ক্ষুদ্র ও মূল অংশ যেটা সময়ের সাথে সাথে বেড়ে ওঠে। তাই এই মূলজ উদ্ভিদের সম্পূর্ণ উৎপাটন, প্রাণের এক অর্থে সমগ্র উদ্ভিদটিরই মৃত্যু ঘটায়, তাই এগুলি খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত।

ব্যাখা হয়ত অনেক, কিন্তু মুল বক্তব্য এক এবং অদ্বিতীয়। পিয়াঁজ ও রসুন মানব মনকে উত্তেজিত করে তোলে, যা মনঃসংযোগের পথে এক প্রবল অন্তরায়। আসলে সব ধর্মের অন্তরনিহিত অর্থটাই - মানুষের আত্মিক উন্নতি সাধন।

Popular posts from this blog

Dashavatar : 10 Avatars of Bhagwan Vishnu!

1. Matsya Avatar 2. Kurma Avatar 3. Varaha Avatar 4. Narasimha Avatar 5. Vamana Avatar 6. Parashurama Avatar 7. Shree Ram Avatar 8. Shri Krishna Avatar 9. Balarama Avatar 10. Kalki Avatar

বলি প্রসঙ্গে আমার মতামত

ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এর চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better, তাহলে বলতে হয় আপনার জীবন আর মৃত্যুর sence নেই। কেন ছাগলের মৃত্যুটাই মৃত্যু? চালকুমড়ো বা আঁখের মৃত্যুটা মৃত্যু নয় কেন? আপনার যদি জীবন আর মৃত্যুর সম্বন্ধ প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তাহলে তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি সমান দুঃখ পেতেন। কিন্ত আপনার মনে হয় ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে চালকুমড়ো বা আখ বলি দেওয়া better।  আপনার এই প্রকৃতি দেখে বলতে হয়, জীবন বাঁচানো আপনার উদ্দেশ্য নয়, বরং আপনি রক্তকে ভয় পান, অস্ত্র কে ভয় পান। আপনার বাস্তবিক বোধ থাকলে আপনি অস্ত্রের আঘাতে চালকুমড়ো বা আঁখের এবং ছাগ তিনটি বলির ই বিরোধীতা করতেন। কারণ তিনটির প্রকৃতিই একই রকম, এই তিনটে থেকেই অনেক নতুন প্রাণের জন্ম হতে পারতো। তাই তিনটির হত্যাই একই রকম ক্ষতি করে। কিন্ত, শুধুমাত্র ছাগ বলি দেখলে যদি আপনার মনে হয় এটি মানুষের হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি সত্যিই অহিংস?  আমাদের মায়েরা প্রতিদিন জ্যান্ত মাছগুলো দুহাতে ধরে বঁটিতে ঘচাং করে একবারে জ্যান্তই কেটে ফেলেন। শহরের মাছ-মাংস বিক্রেতারাও একইভাবে কাটেন। তখন কি সেটা নৃশংসতা নয়? ক...