সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডে অরবিন্দ-বারীন্দ্রের পৈতৃক বাগানবাড়িতে ‘যুগান্তর’ দলের বৈপ্লবিক কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মাতৃমুক্তিযজ্ঞে নিবেদিত-প্রাণ ত্যাগী বিপ্লবীরা এখানে কঠোর ব্রহ্মচর্য ও চরম কৃচ্ছ্বসাধনার মাধ্যমে আগামী দিনের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। দেশব্যাপী সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য এখানে অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। বোমা তৈরি শিক্ষার জন্য মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র দাস কানুনগো পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে প্যারিস যাত্রা করেন।
পূর্বে এই দলে সন্ত্রাসবাদ বা গুপ্তহত্যার কোনও স্থান ছিল না। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান, কিন্তু সরকারি দমননীতির ফলে তাঁরা সন্ত্রাসবাদের পথ ধরতে বাধ্য হন। তারা জানতেন যে দু-চারজন ইংরেজকে হত্যা করে স্বাধীনতা আসবে না, কিন্তু জনমনে প্রবল উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার হবে।
বিপ্লবী সমিতিগুলি তাদের কার্য পরিচালনার জন্য প্রথমে দেশহিতৈষী ধনবান ব্যক্তিদের দানের উপর নির্ভর করত। পরে বিপ্লবী কার্যাবলী বৃদ্ধি পেলে অধিক অর্থের প্রয়োজনে বিপ্লবীরা ডাকাতির পথ গ্রহণে বাধ্য হন।
চন্দননগরের স্বৈরাচারী মেয়র তাদ্দিভেল-এর গৃহে বোমা পড়ে (১১ই এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রিঃ)। বিপ্লবীদের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। প্রাণভয়ে তিনি বিহারের মজঃফরপুরে বদলি হয়ে যান। বিপ্লবী দলের নির্দেশে বাংলার দুই ক্রুণ বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকি ও ক্ষুদিরাম বসু কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য মজঃফরপুর যাত্রা করেন। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল সন্ধ্যার অন্ধকারে তাঁরা কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন। গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না—ছিলেন ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। তাঁরা নিহত হন। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পূর্বেই প্রফুল্ল চাকি মোকামা স্টেশনে নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন এবং বন্দী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় (১১ই আগস্ট, ১৯০৮ খ্রিঃ)। ১৯ বছরের তরুণ ক্ষুদিরাম নিৰ্ভীক-চিত্তে হাসিমুখে বীরের মতো ফাঁসিমঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর আত্মদান সারাদেশে এক ব্যাপক উন্মাদনার সৃষ্টি করে। এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে পুলিশ মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং অরবিন্দ বারীন্দ্র সহ মোট সভাপতি নির্বা সাতচল্লিশ জনকে গ্রেপ্তার করে বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলা শুরু করে (১৯০৮ খ্রিঃ)। আসামিদের পক্ষে উকিল ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ (পরবর্তীকালে ‘দেশবন্ধু)। মামলা চলাকালে নরেন গোঁসাই নামে জনৈক দুর্বলচিত্ত বিপ্লবী পুলিশের কাছে দলের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে থাকলে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু নামে দুই বিপ্লবী জেলের মধ্যে গোপনে পিস্তল আনিয়ে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়। সমগ্র বিশ্বের বিপ্লববাদী ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। আলিপুর বোমার মামলা প্রায় এক বছর চলে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী নায়ক অরবিন্দ ঘোষ মুক্তিলাভ করলেও অধিকাংশ বিপ্লবীরই দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড বা দ্বীপান্তরের শাস্তি হয় (১৯০৯ খ্রিঃ)।
মহারাষ্ট্রে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে (১৮৪৫-১৮৮৪ খ্রিঃ)-র নেতৃত্বে প্রথম গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। তাঁকে ‘ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের জনক' বলা হয়। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ থেকে উচ্ছেদের শপথ গ্রহণ করেন। দেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তাঁর ডাকে সাড়া দেয় নি। তিনি রামোশি, রেজদের কোল, ভিল, ধাঙড় প্রভৃতি অনুন্নত উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য রোহিলা সর্দার ইসমাইল খাঁ তাঁকে পাঁচশো রোহিলা দিয়ে সাহায্য করতে সম্মত হন। সরকারি কোষাগার লুণ্ঠন ও ধনীদের গৃহে ডাকাতির মাধ্যমে তিনি বিপ্লবের ব্যয় নির্বাহ করতেন। তাঁর কার্যকলাপ সরকারের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়।
মহারাষ্ট্রে বৈপ্লবিক চিন্তাধারা বিস্তারে চরমপন্থী তিলকের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জনগণকে গোঁসাই নামে চাঁদ বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি মহারাষ্ট্রে 'সার্বজনীন গণপতি উৎসব’ (১৮৯৪ খ্রিঃ) ও ‘শিবাজি উৎসব’(১৮৯৫খ্রিঃ)-এর প্রবর্তন করেন। 'গণপতি উৎসব’ ছিল মহারাষ্ট্রের এক অতি প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। গণপতি হিন্দুদের রক্ষাকর্তা। বিদেশি খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইংরেজ ও মুসলিমদের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে বিপ্লবীই সর্বপ্রথম এই পারিবারিক উৎসবকে একটি সার্বজনীন ও রাজনৈতিক উৎসবে রূপান্তরিত করেন। বিদেশি মুসলিমদের হাত থেকে শিবাজি হিন্দুধর্ম ও মারাঠা জাতিকে উদ্ধার করেছিলেন। তাই শিবাজির পূণ্য স্মৃতিকে জনমনে জাগরিত করে তিলক দেশবাসীকে জাতীয়তার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করতে সচেষ্ট হন। মহারাষ্ট্রের জাতীয় জাগরণের প্রধান পুরোহিত তিলকের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে দামোদর হরি চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর নামে দুই ভাইয়ের উদ্যোগে পুনা শহরে ‘হিন্দুধর্মের অন্তরায় বিনাশী অপেকর ভ্রাতৃদ্বয় সংঘ' নামে এক গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পুনা প্লেগকে কেন্দ্র ব্র্যান্ড ও তাঁর সহকারী মিঃ আয়াস্ট নিহত হয়। আধুনিক ভারতে এটাই প্রথম সন্ত্রাসবাদী হত্যাকাণ্ড। করে জনসাধারণের উপর অত্যাচার শুরু হলে তাঁদের হাতে প্লেগ কমিশনার
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামোদর সাভারকর (১৮৮৩-১৯৬৬ খ্রিঃ) 'মিত্র মেলা' নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এই সংঘের নতুন নামকরণ হয় 'অভিনব ভারত'। মহারাষ্ট্রের নানা স্থানে এই সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। সভা-সমিতি, প্রচার পুস্তিকা ও শরীরচর্চার মাধ্যমে এই সংস্থা স্বাধীনতার বাণী প্রচার করত। লাঠিখেলা, অশ্বারোহণ, সন্তরণ, পর্বতারোহণ এবং সামরিক শিক্ষাগ্রহণের উপর এই সমিতি গুরুত্ব আরোপ করে। অস্ত্র সংগ্রহ ছিল সংঘের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। রুশ বিপ্লবীদের কাছ থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখবার জন্য এই সমিতির কয়েকজন সদস্য প্যারিসে যান। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সাভারকর লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে তিনি বোম্বাইয়ের বিপ্লবীদের কাছে অস্ত্র ও বোমা তৈরির নিয়মাবলী পাঠাতেন। তাঁর প্রেরিত অস্ত্রের সাহায্যেই ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অনন্ত লক্ষ্মণ কান্হেরি নাসিকের জেলাশাসক জ্যাকসন-কে হত্যা করে ফাঁসি যান। এই উপলক্ষে 'নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা' শুরু হয় এবং লন্ডনে সাভারকরকে গ্রেপ্তার করা হয় (১৯১০ খ্রিঃ)। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং ছাব্বিশ বছর কারাদণ্ড ভোগের পর তিনি মুক্ত হন।
বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার, দ্বীপান্তর বা অন্যান্য শাস্তির পর—বিশেষ করে ‘নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা’-র পর মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনে ভাটা পড়ে। এই কারণে ১৯১২ থেকে ১৯১৭-এর মধ্যে পুরোনো বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে কোনোপ্রকার বৈপ্লবিক তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। অপরদিকে বাংলার ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় নি।
শ্যামজি প্যারিসে চলে গেলে সাভারকরের উপর ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এর পরিচালনার বয়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি গোপনে ভারতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে থাকেন। এই সময় মদনলাল ধিংড়া নামে এক তরুণ বিপ্লবী লন্ডনের বুকে প্রকাশ্য সভায় ইংরেজ সিভিলিয়ান কার্জন উইলি-কে হত্যা করেন (১লা জুলাই, ১৯০৯ খ্রিঃ)।
বলা বাহুল্য, সরকারী দমননীতি বা বঙ্গভঙ্গ রদ করে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সংখ্যা হ্রাস করা গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয় নি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর বড়লাট হার্ডিঞ্জ বিশাল শোভাযাত্রা করে যখন রাজধানী দিল্লিতে প্রবেশ করছিলেন, তখন রাসবিহারী বসু-র পরিকল্পনা-মাফিক ইয়ার পোড়াগাছা গ্রামের ছেলে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস বড়লাটের উপর চন্দননগরে তৈরি বোমা নিক্ষেপ করেন। গুরুতর রূপে আহত হলেও বড়লাট প্রাণে বেঁচে যান। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বিপ্লববাদের ইতিহাসে এ এক অতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘটনা সারা ভারতে প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে—বিপ্লবীরা প্রবলভাবে উৎসাহিত হয়ে ওঠে এবং সরকারি মহলে ত্রাসের সঞ্চার হয়। জোর তৎপরতা সত্ত্বেও সরকার অপরাধীদের কোনও সন্ধান পায় নি। পরের বছর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে পাঞ্জাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডন-কে হত্যার জন্য রাসবিহারীর নির্দেশে লাহোরের লরেন্স গার্ডেনে বোমা রেখে দেওয়া হয়। বোমার আঘাতে এক সরকারি চাপরাশির মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে এইসব ঘটনার রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়। রাসবিহারী আত্মগোপন করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ আমিরচাঁদ, অবোধবিহারী, বালমুকুন্দ ও বসন্ত বিশ্বাস-কে গ্রেপ্তার করে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় এবং বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় (১১ই মে, ১৯১৫)