Skip to main content

চরমপন্থার গতিপ্রকৃতি 


স্বদেশি আন্দোলনের কালে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনটি সুস্পষ্ট পরস্পর-বিরোধী ধারা লক্ষ করা যায়। 

(১) নরমপন্থী—ইংল্যান্ড ছিল তাঁদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল নিয়মতান্ত্রিক পথে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের অধীনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করা। 
(২) চরমপন্থী—তাঁরা ভারতীয় ধর্ম ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’-এর মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। 
(৩) বিপ্লববাদীরা-ও ভারতীয় ধর্ম ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁদের লক্ষ্য ছিল দেশব্যাপী এক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করা। সমগ্র ভারতে বিপ্লববাদী কার্যকলাপ বিস্তৃত হলেও বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাব ছিল এই আন্দোলনের মূল কেন্দ্র।


নরমপন্থী:

১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব নরমপন্থীদের করায়ত ছিল। ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও ধনিক-শ্রেণি পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের শুভবুদ্ধি ও ন্যায়-বিচারের প্রতি তাঁদের প্রকল আস্থা ছিল। ইংল্যান্ড ছিল তাঁদের সর্বপ্রকার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস। 

রাজনীতিক্ষেত্রে তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অধীনে কিন্তু সুযোগ-সুবিধা লাভ করা এবং তা অর্জনের উপায় হিসেবে তাঁরা আবেদন-নিবেদনের নীতি ও সরকারের সদিচ্ছায় বিশ্বাসী ছিলেন। বৎসরান্তে একবার তিনদিনের জন্য মিলিত হয়ে তাঁরা সরকারের কাছে কত ছিল প্রস্তাব পাঠিয়ে দিতেন, কিন্তু সেগুলি গ্রাহ্য হল, কি হল না—সেদিকে তাঁদের কোনও নজর ছিল না।

উনিশ শতকের শেষ দশকে নরমপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা ও তাঁদের কার্যকলাপের বি প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘চরমপন্থী' নামে এক নতুন দলের উদ্ভব হয়। 

চরমপন্থী :

রাজনারায়ণ বসু ও হিন্দুমেলার কার্যকলাপ, দক্ষিণেশ্বরের পূজারি ব্রাহ্মণ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবন ও বাণী, বঙ্কিমচন্দ্র প্রচারিত দেশচর্চার নতুন মন্ত্র এবং স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী দয়ানন্দের বিপ্লবী চেতনা যুব সম্প্রদায়কে নবীন আদর্শে দীক্ষিত করে। তাঁরা প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে শুরু করেন।

ভারতের আধ্যাত্মিক বাণীতে শ্রদ্ধাশীল স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তি দ্বারাই ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। দেশবাসীকে তিনি বলেন যে, “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা”—“দুর্বলতাই হল পাপ”—“কেবলমাত্র সাহসী ও শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা করতে পারে।” ‘স্বাদেশিকতার দীক্ষাগুরু’ বঙ্কিমচন্দ্র ঘোষণা করেন যে, দেশমাতাই হলেন ঈশ্বর, দেশপ্রেমই ধর্ম এবং দেশসেবাই ঈশ্বরের উপাসনা। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দের 'নব্য-হিন্দুবাদ’ যুবমনকে গভীরভাবে আলোড়িত করে।  তিলক, লাজপৎ রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে প্রাচীন হিন্দুধর্মের উপর চরমপন্থী রাজনীতির বুনিয়াদ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। অরবিন্দ ঘোষ বলেন, “স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য এবং একমাত্র হিন্দুধর্মই আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করতে পারে।”


গুপ্ত-সমিতি তথা বিপ্লববাদের যুগ :


১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মার্চ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’-র আদর্শে এবং ব্যারিস্টার পি. মিত্র (প্রমথনাথ মিত্র)-র সভাপতিত্বে কলকাতায় বাংলার প্রথম বিপ্লবীকেন্দ্র ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। লাঠিখেলা ও শরীরচর্চার মাধ্যমে দেশে ক্ষাত্রশক্তি বিস্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতার মদন মিত্র লেনে সমিতির একটি আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। 

 'অনুশীলন সমিতি'র সদস্যদের নিয়মিত ব্যায়াম, মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, সাঁতার কাটা, অশ্বারোহণ ও অসিচালনার পাঠ নিতে হত। এছাড়া, মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য তাদের দেশ-বিদেশের ইতিহাস ও নানা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে হত। ‘গীতা’ ও ‘আনন্দমঠ’ ছিল তাদের অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।

তবে, বিপ্লবী আন্দোলনের কার্যপদ্ধতি নিয়ে অচিরেই পি. মিত্রের সঙ্গে অরবিন্দ-ভ্রাতা বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ-ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, দেবব্রত বসু, অবিনাশ চন্দ্র অন্তর পত্রিকা ও দল ভট্টাচার্য ও অপরাপর তরুণ নেতাদের বিরোধ বাঁধে। তাঁরা পি. মিত্রের ‘নীরব শরীরচর্চার নীতি'-র পরিবর্তে বিপ্লবী আদর্শ প্রচার ও বৈপ্লবিক কার্যাবলীর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। 

বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের জন্য অরবিন্দ ঘোষের পরামর্শ ও ভগিনী নিবেদিতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বারীন্দ্র ও ভূপেন্দ্রনাথের উৎসাহে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘যুগান্তর' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা সরাসরি সশস্ত্র পথে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতার বাণী প্রচার করত।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীরা অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রাজশাহি, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, কটক ও কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ‘অনুশীলন সমিতি'-র শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কেবলমাত্র 'অনুশীলন সমিতি’-র ঢাকা কেন্দ্রের অধীনেই কমপক্ষে ৫০০টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি'-র প্রধান পরিচালক ছিলেন পুলিনবিহারী দাস। অনুশীলন সমিতি’ ছাড়াও এ সময় বাংলাদেশের নানা স্থানে একাধিক ‘গুপ্ত সমিতি’ গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে নে ময়মনসিংহের ‘সাধনা সমিতি’ ও ‘সুহৃদ সমিতি’, ফরিদপুরের ‘ব্রতী সমিতি', ঢাকার ‘মুক্তিসংঘ' প্রভৃতি।

Popular posts from this blog

 বর্তমানে রাত্রীকালীন বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা :- ____________________________________ মুসলমান অত্যাচারের কারণে 'রাত্রি কালীন গোপন বিবাহ' রীতির প্রচলন। এসব সত্য জানার সত্ত্বেও এখনও এই রীতি বয়ে নিয়ে হচ্ছে। তার সম্ভাব্য কারণ কি কি হতে পারে? ১| দিনের বেলা সকলে ব্যস্ত থাকে নানা কাজে। কেও স্কুলে, কেও অফিসে কেও বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকেন। তাই সেই কাজের মাঝে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই সন্ধ্যার লগ্নে বিয়ে হলে মানুষ দুপুরে কাজের শেষে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যেয় সেজেগুজে এসে বিয়ে দেখতে পারে। রাত্রে প্রায় সকলেই বাড়িতে থাকেন। তাই কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করা বিষয়টা অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাট মনে হয়। ২| এখন বিবাহ একটি পারিবারিক উৎসব নয়। বরং বিবাহ আত্ম অহংকার, ক্ষমতার প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। রাতে জমকালো Light Show দেখানো যায়। বাজীর প্রদর্শনী করা যায়। এর সাথে আরও যত রকমভাবে নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন করা সম্ভব সবরকম চেষ্টাই করা হয়। কিন্ত দিনে এই সমস্ত ঘটনার Prime Focus একজনের উপর পড়া সম্ভব নয়, তাই রাত্রে। ৩| সামাজিক দৃষ্টিকোণ: বর্তমানে দিনে বিবাহ দেওয়াকে দারিদ্রতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ...

ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার তত্ত্বের Propaganda Vs Reality

ভারত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলে প্রায় 50 কোটি মুসলিম বাস করে। কিন্তু, এতো মুসলিম তো আরবেও নেই। তাহলে এতো মুসলমান এলো কোথা থেকে? অন্য ধর্মের লোক এতো দ্রুত হারে বাড়ছে না কেনো? অন্য ধর্মের 50 কোটি লোক হলোনা কেনো ? Communist আর secular দের বক্তব্য এরা হিন্দুই ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে আর মুসলিমদের ধর্মের উদারতার কারণে জাত-পাতহীনতার কারণে এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এরা মুসলিমদের দান-ধ্যানের নীতি, সুফি_সন্তদের জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়ে "ইসলাম" ধর্ম গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার তত্ত্ব  Communist রা হিন্দু সমাজকে দুইভাগে ভাগ করেন-- 1. উচ্চ বর্ণ  2. নিম্ন বর্ণ সমাজের সবচেয়ে ভক্তিবান মানুষ হলো তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষরা। তাদের কাছে ধর্মই সব। তাঁরা সব করতে পারেন কিন্তু ঠাকুর কে অবহেলা করেন না। তাঁরা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের জন্যেই ধর্মান্তরিত হয়েছে এটা বিশ্বাস করেন কিভাবে❓ এটা তো গেলো পুরোনো যুগের কথা.... এবার এখনকার কথা বলি.... আচ্ছা বলুন তো, আমরা আমাদের পারিবারিক সূত্রে বা বন্ধুদের সূত্রে প্রায় প্রতিদিন নানান রকম খবর শুনি। যেমন- কারোর বিয়ে হয়েছে, কার...

বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথালয় এর সংযুক্তিকরণ

আমি কিছু ছোট ছোট old age home এবং orphan home এ গেছি এবং সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে বৃদ্ধ মানুষগুলো তাঁদের পরিবারের ছোটো-ছোটো নাতি-নাতনীদের মিস করেন। আবার অনাথালয়ের orphan দের কাছে গিয়ে মনে হয়েছে তারা যদি দাদু ঠাকুমাদের মত কাওকে পেত, যারা তাদের একটু গল্প বলবে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের আদর করবে তাহলে তারাও হয়ত অনেকটা ভালো থাকত। তাই আমার মনে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম ও orphan home যদি একই ছাদের নীচে করা সম্ভব হয় তাহলে ওইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার যে কষ্ট, সেটা সামান্য হলেও লাঘব হবে। এবার আমি এটা নিয়ে কতটা ঠিক ভেবেছি বা এটা ইমপ্লিমেন্ট করা কতটা সম্ভব বা তার প্রতিবন্ধকতার জায়গা গুলো আমি সম্পুর্ন ওয়াকিবহল নই। সম্পূর্ণ একটা ইমোশনাল ভাবনা থেকে এটা আমি ম্যাডামকে জানিয়েছি। ম্যাডাম বা ডিপার্টমেন্ট এ যারা দীর্ঘদিন ধরে অনেক গুরুদায়িত্ব সামলেছেন তাঁদের সবার পর্বত সমান অভিজ্ঞতা। যদি তাঁরা এই ভাবনার মধ্যে কোনো পজিটিভ দিক আছে বলে মনে করেন এবং প্রাকটিক্যাল গ্রাউন্ডে এটা ইমপ্লিমেন্ট করা সম্ভব মনে করেন এবং এক ছাদের তলায় old age home এবং orphan home তৈরী করা...