দাড়িভিটের স্ফুলিঙ্গ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রদীপ জ্বালাতে আমরা ব্যর্থ

 লাল সিং চাড্ডা, FOMO, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে আর ভারত চলন্তিকা |

• ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

একের পর এক ছবি বক্স অফিসে মার খাচ্ছে। তিন ঘণ্টার ছবি হলে ফ্লপ অথচ OTTতে হিট। কারণ খুঁজতে পন্ডিতদের হাই পাওয়ার্ড মিটিং এর পরে পাঁচ তারায় টিফিন। তারপর ফের মিটিং। অবশেষে উপসংহারে পৌঁছানো, যে ছবি বয়কট হবে না সেই ছবি বানাও । মানে ধরুন মনিকর্নিকা বা পৃথ্বীরাজ গোছের। কিন্তু সেটাও তো ফ্লপ। তাহলে উপায়?

আমি ফিল্ম বোদ্ধা নই। সিনেমাকরিয়ে নই। সামান্য টিভি কর্মচারী। একটি নিউজ চ্যানেলের কনটেন্ট ক্রিয়েটর। হ্যাঁ, এখন সবকিছুই কনটেন্ট। আপনাকে গাছ থেকে পেড়ে খবর দিলে, আপনি খাবেন না। কেটেকুটে, ধুয়ে, সুন্দর প্লেটে সাজিয়ে দিতে হবে। পাশে একটা কাঁটা চামচ রাখতে হবে। প্রয়োজন পড়লে খাইয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে। কারণ আপনার হাতে রিমোট কন্ট্রোল। পরের চ্যানেলে পৌঁছাতে ৫ সেকেন্ড।

আমি বেশ কিছুদিন ধরে এই ট্রেন্ডটা লক্ষ্য করে যা বুঝলাম, মহামারী পরবর্তী বিশ্বে আমরা আসলে সবাই FOMO আক্রান্ত। এটা মনবিদরাও বলছেন। FOMO অর্থাৎ Fear of Missing out. পিছিয়ে পড়ার ভয়। মিস করে যাওয়ার ভয়। ঘুমাচ্ছেন যখন পৃথিবী বদলে যাওয়ার ভয়। তাই তো আমাদের মধ্যে অনেকেই ঘুম থেকে উঠে সবার আগে মোবাইল চেক করি, কোন মিস কল রয়েছে? হোয়াটস্যাপ মেসেজ রাতে কে কে করেছে? ফেসবুকে কতগুলো নোটিফিকেশন এল? প্রিয় অভিনেতার নতুন ইনস্টাগ্রাম পোস্ট মিস করে গেলাম ১ঘণ্টা আগে? ১২২টা ব্রেকিং নিউজ জানিনা? ভাবছেন এটা নতুন প্রজন্মের রোগ? বিয়েবাড়ি যেতে গিয়ে টেলি সিরিয়ালে আজ সন্ধেবেলায় লক্ষ্মী পিসি কী করলো? মিস করে গেছেন বলে দৌড়ে রাতে রিপিট টেলিকাস্ট দেখেন না?

এই FOMO মনে হয় হলে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিকূলতা। তিন ঘন্টা! মানে ৩৩৩টা ছোট ভিডিও ফেসবুকে মিস, ইউটিউবে ৪০০টা গান শুনে নেওয়া, OTT PLATFORMS এ ওয়েব সিরিজের তিনটে এপিসোড দেখে নেওয়া, তিন ঘণ্টায় ফেসবুক নিউজ ফিড পুরো বদলে যাবে। কেউ ঘুরতে যাওয়ার ছবি দেবে, তাতে কে কী কমেন্ট করবে দেখা হবে না সঙ্গে সঙ্গে। হয়তো কেউ ফোন করবে, ঠিক সময় ধরা হবে না। FOMO !

Forest Gump, Castaway বা লাল সিং চাড্ডার মত ছবি এই হার্ডলটা পার করতে পেরেছে। মানে শত কিছু জিনিস মিস করে যাওয়ার ভয় থাকলেও তিন ঘণ্টা বসে দেখতে হবে। হেসে ফেলতে হবে কাঁদতে হবে, থম মেরে বসে থাকতে হবে, একটা চাপা বুকে ব্যথা নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে হল থেকে। লাল সিং চাড্ডা বড্ড ভালো। দেখে আসুন। বয়কট, ফ্লপের জিগির যাই থাকুক। অনেক অনেক দিন দৌড়তে দৌড়তে একটু দাঁড়াও, পথিক-বর, তিষ্ঠ ক্ষণাকাল।

লাল সিং চাড্ডা আমাদের দেশের খন্ড খন্ড চিত্র তুলে ধরেছে ১৯৮২ সাল থেকে ২০১৮ অবধি। নিজের মত তুলে ধরেছে। ১৩০ কোটি মানুষের যেমন নিজের নিজের গল্প আছে। শিখ হিংসার সময়, ভারতের বিশ্বকাপ জেতার সময়, বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার সময়, ৯৩ এর বিস্ফোরণের সময়, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার সময়। আমরা সবাই কী আর একই কাজ করছিলাম যখন কার্গিল যুদ্ধ হয়? আমাদের সবার জীবন কি একই রকম ছিল? লাল সিং চাড্ডা ১৩০ কোটি গল্পের একটা।

কিন্তু লাল সিং চাড্ডা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল তো। গোধরাতে একটা ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া হল, লাল কোথায় ছিল? কী করছিল? জানা হল না। না জানতে দেওয়া হল না? গুজরাট পর্বটাই বাদ রাখা হল তাই? লাল সিং কার্গিল যুদ্ধের এক সন্ত্রাসবাদী কমান্ডারকে বাঁচালেন শুধু না, তাকে কোম্পানির ডিরেক্টর করে দিলেন, পরে পাকিস্থান ফিরেও গেল সে। কার্গিল, ২৬/১১ যারা প্রত্যক্ষ করেছে, যারা লাল সিং এর মতই সাধারণ, আবেগপ্রবণ তাদের খারাপ লেগেছে বই কী! Problematic দৃশ্য কিছু। মানে ভালো, দারুণ এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা। তবে আমির খান সিনেমাটা নষ্ট হতে দেননি। যে রং দে বাসন্তী বানিয়েছে, লাগান বানিয়েছে তার কাছে দেশপ্রেমের কয়েক মুহূর্ত তৈরি জলভাত!

কিন্তু কী অদ্ভুত। আমির খানও হলে দর্শক টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না। যে যতই সিনেমার সঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট করুক, আমির খান বস নাম হি কাফি হে! সেই ম্যাজিকও দিকে। হৈ হৈ করে সবাই যেতাম। সেটাও আর হচ্ছে না। আমাদের সবার হৈ হৈ করে রেস্তোরাঁ যাওয়াও তো কমে গেছে। হাউস পার্টি করি, সুইগি থেকে পিজা এমনকি পানীয় পর্যন্ত আসে হোম ডেলিভারিতে। ব্যালকনিতে ই নিজের পাব বানিয়ে ফেলে আজকের প্রজন্ম। স্মার্ট টিভিতে হয়তো কোরিয়ার কোন ওয়েব সিরিজ চলছে। সিনেমা হলগুলো একটা Magnum Opus এর অপেক্ষায়। ফের পপকর্ন বিক্রি হবে, গরম প্যাটিসের গন্ধ, ফাউন্টেন কোকের শব্দ, অন্ধকার হলে তিন ঘন্টা। লাল সিং চাড্ডা মধ্যবিত্ত এক নেহাত হাবাগোবাকে নিয়ে বানানো Magnum Opusi প্রথমবার হলেই দেখা ভালো। পরেরবার OTT!

🖊 ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ