খাদ্যের আমিষ-নিরামিষ🌰 🧄

৩. মায়া, ইনকা ও অ্যাজটেক সভ্যতার রহস্য সমাধান কি ভারতেই নিহিত আছে?

↔ ক্যাপ্টেন অজিত বড়াকায়িল, ২৪ জুলাই ২০১২

° ভারত ও মেসোআমেরিকা সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য

এবার আসা যাক ভারত ও মেসোআমেরিকা সভ্যতাগুলির মধ্যে কি কি মিল আছে তা খুঁজে বের করার প্রসঙ্গে। অনুমান করা হয় আজ থেকে ১১০০০ বছর আগে ভারতীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল মেসোআমেরিকা। 

ভারতে যেটা পঁচিশি গেলা নামে পরিচিত, সেটাই মেক্সিকোতে পাটোল্লি নামে পরিচিত। দুই খেলার নিয়ম পুরো এক। কোনও সন্দেহ নেই, প্রাচীন মেক্সিকানরা ভারতীয়দের সংস্পর্শে এসে এই খেলা শিখেছিল ও পরবর্তীকালে নিজেদের মত করে খেলার নিয়মকে কিঞ্চিৎ অদলবদল করেছে। মেক্সিকোর ইন্ডিয়ানরা কুমোরদের কুমহার বলে। নিঃসন্দেহে সংস্কৃত ‘কুম্ভর’ শব্দ থেকে কুমহার এসেছে। এরকম প্রচুর ‘ইন্ডিয়ান’ শব্দ আছে, যার উৎস সংস্কৃত ভাষা। 

বৈদিক সভ্যতার পরে মায়ারাই প্রথম সভ্যতার জনগণ, যারা শূন্যের ব্যবহার শিখেছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায় মায়ারা এই বিদ্যা কোনও ভারতীয়র কাছ থেকেই শিখেছিল। ভারতীয়রা শূন্য আবিষ্কারের প্রায় হাজার বছর বাদে মায়ারা প্রথম জাতি হিসাবে প্রথম শূন্যের ব্যবহার শুরু করেছিল। বহু মায়া ভাস্কর্যে আশ্চর্যজনক ভাবে বিমান ও স্পেস স্যুটের চিত্র পাওয়া যায়। তারা যে দেখেছিল তাই ভাস্কর্যের আকারে রূপ দিয়েছিল। ভারতীয় ময় দানব নিঃসন্দেহে স্পেস স্যুট পড়ে বিমানে চেপে সেখানে হাজির হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মায়া ভাস্কর্যে শিব ও কুণ্ডলিনী চক্রের হদিশ পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কোথা থেকে শিব বা কুণ্ডলিনী চক্রের কথা জানলো? অবশ্যই ভারত থেকে। কোনও সন্দেহ আছে কি? 

উত্তর ও মধ্য আমেরিকায় কোথাও হাতি নামক প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কস্মিনকালেও ওখানকার মানুষ হাতি দেখেনি। অথচ হন্ডুরাসের কোপান নামক স্থানে একটি মায়া শিলাস্তম্ভে হাতির নিখুঁত চিত্র খোদাই করা আছে। তাও আবার ভারতীয় হাতি, আফ্রিকান হাতি নয়। ভারতীয় হাতিরা পোষ মানে, যেটা আফ্রিকান হাতিরা মানে না। খোদাই করা হাতির চিত্রে দেখা যাচ্ছে হাতিরা আয়না দেখে মাথা দোলাচ্ছে। মানুষ ব্যতীত হাতিই একমাত্র প্রাণী, যে আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে বুঝতে পারে, আয়নার ভেতরে কেউ নেই। যেটা অন্য কোনও প্রাণী বুঝতে পারে না। 

প্রত্নতত্ত্ববিদরা মেক্সিকোর ইউকাটান, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজে ইত্যাদি দেশ জুড়ে সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে শিব, গনেশ, কালী, কৃষ্ণ, সূর্য এমনকি বুদ্ধের (বিষ্ণু?) মত দেখতে ভাস্কর্যের হদিশ পেয়েছে। সামান্য এদিক ওদিক বাদে ভাস্কর্যগুলি যে হিন্দু দেবদেবীরই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মায়ারা এদের অন্য নামে পূজা করত। 

মেক্সিকোর ইউকাটানে প্রচুর পরিমাণে হাতি দেবতার ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। ভাস্কর্য ভালোভাবে দেখলে একদন্ত গণেশের কথাই মনে পড়ে যায়। মায়ারা গণেশকে ‘’ নামে ডাকত। 

গুয়াতেমালার জঙ্গলে একটি ৫০ ফুট উঁচু, ১২ ফুট প্রস্থ একটি বানর দেবতার বিগ্রহ পাওয়া গেছে। বিগ্রহের তলায় মায়ান ভাষায় লেখা আছে, “আমরা উইল্কা হুয়েমানা দেবতার উপাসক। তার সম্মানে এই বিগ্রহ নির্মিত হল।” মায়া ‘হুয়েমানা’ যে হনুমানের বিকৃত উচ্চারণ তাতে সন্দেহ নেই। মেক্সিকো সিটিতে একই ধরণের বানর দেবতার বিগ্রহ পাওয়া গেছে একটি অ্যাজটেক মন্দিরে। অ্যাজটেকরা একে ‘এউহেক্টাল’ বা পবনপুত্র বলত। যুগপৎ রামায়ণ ও মহাভারতে পবনপুত্র বলতে হনুমানকেই বোঝায়। নিঃসন্দেহে দুই জায়গায় প্রাপ্ত বিগ্রহ হনুমান দেবতার বিগ্রহ বলা যেতে পারে। 

কোপানের কাছে একটি হিন্দু মুদ্রায় খোদাই করা বিগ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ধরণের মুদ্রা হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের লোক ব্যবহার করে না, এমনকি বৌদ্ধরাও নয়। 

অ্যাজটেক পঞ্জিকাও এক আশ্চর্য জিনিস। মেক্সিকো সিটির কাছে একটি অ্যাজটেক শিলালিপি পাওয়া গেছে, যা সম্পূর্ণ বৃত্তাকার। তা ১২ ফুট ব্যাসার্ধের, তাতে পঞ্জিকা খোদাই করা আছে। শিলালিপির ওজন হবে ২০ টনেরও বেশি। 

মেক্সিকোতে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি উৎসব হয় এখনও, নাম সিতুয়া-রাইমি। নিঃসন্দেহে দশেরা উৎসবের মেক্সিকান রূপ সেটা। ‘হ্যামসওয়ার্থ হিস্ট্রি অফ ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থের ৫৮৬৭ পৃষ্ঠায় সিতুয়া-রাইমি উৎসবের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। 

যুগপৎ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় সতীপ্রথা, পৌরোহিত্য, গুরুকুল প্রথা, যজ্ঞ, জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহের যেসব প্রক্রিয়া এককালে চালু ছিল; তা হিন্দুদের অনুরূপ। এমনকি ইনকারা উপনয়ন প্রক্রিয়াও জানত। পিজ্জারোর হাতে শেষ ইনকা রাজা আতাহুয়াল্পার ম্রিত্যর পর তার চার স্ত্রী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বলে তৎকালীন স্প্যানিশ ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন। নিঃসন্দেহে তা সতীপ্রথার ইনকা রূপ বলা চলে।  

হিন্দুদের মতই মেসোআমেরিকানরাও প্লাবন, পুনর্জন্ম, চার যুগ, রাহু ও কেতুর কারণে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ হয় তা মানত।  

আদি মেসোআমেরিকানরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে পোশাক, পরিচ্ছদ পড়ত; তার সাথে প্রাচীন হিন্দুদের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়। দুই আমেরিকার ইন্ডিয়ান মেয়েদের দেখলে উত্তর ভারতীয় মেয়ে বলে ভুল হতে পারে। দুই অঞ্চলের মেয়েদের কোমর একই রকম পাতলা, চওড়া পাছার হাড়, লম্বা কালো কুচকুচে চুল ও একই রকম মুখমণ্ডল থাকাটা বিস্ময়ের উদ্রেগ করে। 

অ্যাজটেক ‘আয়ার ইনোয়া’ রাজারা যে ধরণের পাগড়ি, আকনের দুল, হাতের বালা ও ত্রিশূলের মত দেখতে রাজদণ্ড ব্যবহার করত, তার সাথে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকের হিন্দু ভাস্কর্য ও মুদ্রায় খোদাই করা রাজার ছবির অসাধারণ মিল কারুর চোখ এড়াবার নয়। 

হিন্দু ও মেসোআমেরিকানদের মধ্যে একই ধরণের খাদ্যাভ্যাস প্রচলিত ছিল। তারা তুলো দিয়ে তৈরি পোশাক পড়ত। তুলো তারা ভারতের কাছ থেকেই পেয়েছিল। সেখানে ভুট্টা প্রধান খাদ্য ছিল বলে, ইন্ডিয়ানরা টরটিলা নামে একটা জিনিস খেত, যা ভুট্টা পিষে তৈরি হত। টরটিলা দেখতে একদম ভারতীয় চাপাটির (মোটা রুটি) মতন। হিন্দুদের মতই মেসোআমেরিকানদের মধ্যে মশলাদার খাদ্যের প্রচলন ছিল। তারা অদ্যাবধি এমন সব মশলা দিয়ে রান্না করে, যা উপমহাদেশের বাইরে কোথাওই চালু নেই। 

ব্যারন অ্যালেকজান্ডার ভন হাম্বোল্ডট দুই আমেরিকা ও ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য নিয়ে তার গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। 

১৮৬০ থেকে ৬৬ সাল অবধি ফ্রেঞ্চ আর্কিটেক্ট ইউজিন ভায়োলেট লে দুচ দক্ষিণ ভারত ও মেক্সিকো অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তার গ্রন্থে অ্যাজটেক ও দ্রাবিড় স্থাপত্যের সাদৃশ্যের উল্লেখ মেলে। তার মতে, দুই স্থাপত্য যেন যমজ ভাইয়ের মত আশ্চর্য রকমের সদৃশ।   

হিন্দুদের মধ্যে যেমন দেবত্রয় বা ত্রিমূর্তির ধারণা আছে, সেরকম প্রাচীন অ্যাজটেকদের মধ্যেও ত্রিমূর্তির ধারণা ছিল। ভারতে যেটা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, সেটাই অ্যাজটেকদের কাছে হো-টলালোক-হুইটজ়িলোপোচটলি নামে পরিচিত। 

শুধু হিন্দুদের কাছে স্বস্তিকা পবিত্র ধর্মীয় প্রতীক ছিল না, মায়াদের কাছেও স্বস্তিকা পবিত্র প্রতীক ছিল। তারা স্বস্তিকাকে বলত ‘হুয়াকো’।  

গুয়াতেমালার পালেঙ্কে শহরে একটি অদ্ভুত বিগ্রহের ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। তাতে একটি শিরস্ত্রাণ পড়া বানর বাঁহাতে পাহাড় ও ডানহাতে একটি মুষল নিয়ে উড়ে যাচ্ছে এমন অবস্থায় দেখা যায়। নিঃসন্দেহে ইহা গন্ধমাদন পর্বত বহন করা হনুমানের চিত্র। 

বলিভিয়া ও পেরুর দক্ষিণে এক ধরণের লোকনৃত্যের প্রচলন আছে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে, যা ‘লা দায়াব্লাদা’ নামে পরিচিত। স্প্যানিশে শব্দটির অর্থ ‘শয়তানের নাচ’। তাতে দুই রাজপুত্র, একটি দশ মাথা ওয়ালা দানব ও একদল বানরের মুখোশ পড়ে নাচতে নাচতে যুদ্ধ করার ভঙ্গিমা প্রকাশ পায়। নিঃসন্দেহে রামায়ণের গল্পটাই ইন্ডিয়ানরা এইভাবে ‘সেলিব্রেশন’ করে। স্প্যানিশদের কাছে এইরুপ প্যাগান লোকনৃত্য পছন্দের জিনিস ছিল না, তাই এমন নামকরণ করেছে।  

কুয়েচুয়া ভাষায় ইনকাদের ‘দিনাক’ বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে সংস্কৃত দিনকর থেকে দিনাক শব্দটা এসেছে, যার অর্থ ‘সূর্যপুত্র’।

অনুবাদ: অয়ন চক্রবর্তী