Skip to main content

সিঁদুরের ইতিহাস: সিঁদুর পড়া যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক

 সিঁদুরের ইতিহাস অতি প্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। হিন্দু ধর্মমতে এটি স্বামীর দীর্ঘজীবন বয়ে আনে বলে বিবাহিত হিন্দু নারীরা সিঁদুর ব্যবহার করেন। এর রঙ লাল, কারণ এটি শক্তিভালোবাসার প্রতীক। হিন্দু বিবাহের সময়ে একজন নারীর প্রথম কপালে সিঁদুর দিয়ে চিহ্ন আঁকা হয়।


নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা:

হিন্দু নারীর সিঁদুর পরা নিয়ে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব ভিন্ন কথা বলে। সেই বিদ্যার বিশেষজ্ঞদের মতে, লাল বর্ণের সিঁদুর কপালে ধারণ করার অর্থ জড়িয়ে রয়েছে আদিম উর্বরাশক্তির উপাসনার মধ্যে। হিন্দু ধর্ম বলে আজ যা পরিচিত, তার উৎস এক টোটেমবাহী কৌম সমাজে। সেখানে গাছ, পাথর, মাটি ইত্যাদিকে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক বলে মনে করত। আর তাদের কাছে লাল রংটি ছিল সৃষ্টির প্রতীক। সেই আদিম কাল থেকেই লাল সিঁদুরকে ভারতীয়রা বেছে নেন তাদের একান্ত প্রসাধন হিসেবে। বিবাহিতা মহিলাদের ললাটে কুঙ্কুম তাদের সন্তানধারণক্ষম হিসেবেই বর্ণনা করে। তার বেশি কিছু নয়।


শাস্ত্র অনুযায়ী, লাল কুঙ্কুম শক্তির প্রতীক। মানব শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেবতা অবস্থান করেন। ললাটে অধিষ্ঠান করেন ব্রহ্মা। লাল কুঙ্কুম ব্রহ্মাকে তুষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া, কপালের ঠিক মধ্যভাগে সূর্যালোক পড়ার ব্যাপারটাকে আটকাতেও সিঁদুর ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা যায়।


কপালে সিঁদুর প্রয়োগেরও কিছু বিধি ও ফলনির্দেশ শাস্ত্র প্রদান করে। জানা যায়, তর্জনি দিয়ে সিঁদুর পরলে শান্তি পাওয়া যায়। মধ্যমা দিয়ে ধারণ করলে আয়ু বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন কালে হলুদ গুঁড়ো দিয়ে সিঁদুর তৈরি হত। তার পরে তাতে লাল কালি মিশিয়ে রাঙিয়ে তোলা হত। কুঙ্কুমচর্চার কেন্দ্রবিন্দুটি হল আজ্ঞাচক্র। এখানে সিঁদুর প্রয়োগে আত্মশক্তি বাড়ে। নারীকে ‘শক্তি’ হিসেবেই জ্ঞান করে হিন্দু পরম্পরা। কুঙ্কুম বা সিঁদুর তাদের আজ্ঞাচক্রে প্রদানের বিষয়টি সেই কথাটিকেই মনে করিয়ে দেয়।


বামপন্থীদের মিথ্যাচার : 

সিঁদুরের উৎপত্তি প্রসঙ্গে নারীবাদী বিশেষতঃ বামপন্থী গবেষকরা বলেন প্রাচীন কালে নারী যখন পিতৃতন্ত্রের হাতে পুরুষের সম্পত্তি হয়ে পড়ল তখন কোনো নারীকে অধিকার করার পর পুরুষ ধারালো পাথর বা ধাতু দিয়ে তার কপালে ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিত। সেই রক্তাক্ত ক্ষত পরে সিঁদুরে রূপান্তরিত। এরকম ক্ষত চিহ্ন সহ কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

এ বক্তব্য খুব জোরালো প্রতিষ্ঠিত হয় না। কঙ্কাল পাওয়া যেতেই পারে। কোনো আদিম গোষ্ঠী হয়ত অন্য গোষ্ঠীর নারীদের বিজয়ের পর এই কাজটা করত। কিন্তু তার সঙ্গে হিন্দু সিঁদুরকে সুনিশ্চিত মিলিয়ে দেয়া যায় না। কারণ তাহলে পূথিবীর আরো বহু জায়গায় অন্য সভ্যতাতেও ঐ ধারা বাহিত হত ও নারীর এ জাতীয় বিবাহ চিহ্ন থাকত। নারী সর্বত্র পুরুষের হাতে পরাধীন ছিল। কেবল নর্ডিকদেরও যদি দায়ী করা হয় তাহলেও নর্ডিক কেবল ভারতে নেই। অন্যত্রও আছে। নর্ডিক প্রধান আরো দেশ আছে। সেখানে হল না। হল কেবল বৈদিক ভারতে ?


হিন্দু সংষ্কৃতিতে পুরুষকে কোনো বিবাহ চিহ্ন বহন করতে হয় না। হয় নারীকে। এই একপেশে প্রথা সৃষ্টির কারণ প্রথাটা প্রাচীন। সে যুগে সাম্য আশা করা যায় না। সেই প্রাচীন সমাজে কেবল নারীকে বিবাহ চিহ্ন বহন করানোর সম্ভাব্য কারণ একাধিক।

সমাজ এক সময়ে ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারী ছিল যৌন স্বাধীন। বিবাহ প্রথা ছিল না। পরে সম্পদ সৃষ্টির পর যখন পিতৃতন্ত্র ক্ষমতা দখল করল তখন উত্তরাধিকারের স্বার্থে বিবাহ প্রথা সৃষ্টি করে নারীকে যৌন পরাধীন করা হল। কোনো এক পুরুষের নির্দিষ্ট নারী বলে চিহ্নিত করা হল। মুক্ত নারীকে সমাজের সামনে বিশেষ কারোর নির্দিষ্ট চিহ্নিত করতে চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাতে সামাজিক অনর্থ ঠেকানো যায়। এছাড়া যৌন স্বাধীন বহুগামী নারীর শরীরে চিহ্ন এঁকে তার চেতনায় প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যে সে আর বহুগামী নয়। কোনো এক পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট। স্বামীর মঙ্গল কামনা করতে করতে রোজ সিঁদুর পরতে পরতে তার চেতনা যাতে একগামী হয়ে পড়ে।


---তবে এ কারণ দুটোও খুব জোরালো হয় না। কারণ প্রতীক এঁকে না অনর্থ ঠেকানো যায়, না কাউকে একগামী করা যায়। আর সে প্রতীক মাথার বদলে কপালে লম্বা করে কাপালিকদের মতও আঁকানো যেত। তাতে আরো বেশি নজরে পড়ত। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যত্রও এ প্রথা থাকতে পারত।


প্রকৃত কারণ :

যে কারণটা সব থেকে জোরালো হয় তা হচ্ছে জ্যোতিষ ও ফিমেল বায়োলজি। বৈদিক ভারত ভীষণ ভাবে জ্যোতিষ ও ফলিত জ্যোতিষে উন্নত ও নির্ভর ছিল। জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী লাল রঙ মঙ্গল গ্রহের প্রতীক। মঙ্গল গ্রহ একাধারে যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ, শৌর্য-বীর্য, সাহস, ভূ সম্পত্তির প্রতীক, তেমনই শারীরিক শক্তি, সুস্থতা, রক্তপাত, রক্তজনিত ব্যধি, অপারেশন, নারীর যৌন ক্ষমতা, উর্বরতা ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতীক।

মেয়েদের ঋতুস্রাব থেকে সন্তান ধারণ ও প্রসব সবই করতে হয়। এ সবের সঙ্গে রক্ত বিষয়টি জড়িত। এসব কারণে রক্তাল্পতায় ভুগতে হয়। এছাড়া স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান থেকে সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে সাংসারিক সুখ শান্তি জড়িত। সন্তান উৎপাদন করতে ও সংসারে শারীরিক শ্রম দিতে শক্তি ও সুস্থতা প্রয়োজন। নারীর মঙ্গল শুভ হলে সাংসারিক স্থাবর সম্পত্তি অটুট থাকারও লক্ষণ।

তাই এরকম অনেক কিছু মিলিয়ে মঙ্গলকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বিবাহিতা মেয়েদের মাথায় লাল সিঁদুর (মাথায় কারণ কালপুরুষের মাথা মেষ রাশি যা মঙ্গল গ্রহের ঘর) কপালে লাল কুমকুম, হাতে লাল পলা ও পায়ে লাল আলতা পরানোর রেওয়াজ তৈরি হয়। একই সঙ্গে চন্দ্র ও শনিকে শুভ করতে হাতে শঙ্খ বা শাঁখা ও লোহার নোয়া পরানো হয় যাতে ঐ তিন গ্রহের শুভত্বে মেয়েদের মতি স্থিরতা, বিবেচনা বোধ এবং রজঃ ও প্রসব শুভ হয়।

Popular posts from this blog

বাংলার বারুজীবী বৃত্তান্ত

একসময় পান সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন করার প্রথা ছিল গ্রাম বাংলায়। তারপর ভোজের শেষে মুখুশুদ্ধি হিসেবেও পানের ব্যবহার ছিল তখন ।পান রাঙ্গা ঠোঁট ছিল আজকের সুন্দরীদের লিপস্টিক এর বিকল্প। আর এই পানের চাষ ও বিক্রির সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের বলা হতো বারুজীবি বা বারুই। পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া ,হুগলি ও বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়িতে রয়েছে বারুইপাড়া ।এছাড়া দুই মেদনীপুর সহ অন্যান্য জেলাতেও কমবেশি এই সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। একেবারে নিরীহ শান্ত সৌম্য ভীতু প্রকৃতির সম্প্রদায় ।তবে শৈল্পিক চিন্তাধারা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে এই সম্প্রদায়ের। উৎপত্তি - বারুজিবী জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে একটি প্রচলিত লোককথা রয়েছে ।সেখানে বলা হয়েছে এক শিব ভক্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন ।তিনি প্রতিদিন শিব পূজা করতেন। কিন্তু, তার আরো অনেক কাজ ছিল ।যেমন যেমন পান চাষ, কাপড়বোনা প্রভৃতি।ব্রাহ্মণের বেশিরভাগ সময় চলে যেত ওই কাজে।তারপর কোন এক সময় পেলে শিবের মাথায় দুই একটি ফুল ছুঁড়ে কর্তব্য সারতেন। এসব দেখে শিব ঠাকুর তাকে আন্তরিকভাবে শুধুমাত্র তার পূজা করতে বললেন। এবং আরো জানিয়ে দিলেন তা করলে তার কোন অভাব থাকবে না। কিন্তু, ব্রাহ্মণ সে ...

Déjà Rêve: স্বপ্ন যখন বাস্তব

 Déjà Rêve: স্বপ্ন যখন বাস্তব ↓ স্বপ্ন আমাদের মস্তিষ্কের সৃষ্ট কিছু চিত্র বা গল্প যা আমরা ঘুমের ভিতর মনের অবচেতনে দেখি। ঘুমের যেকোন পর্যায়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। তবে সাধারণত ঘুমের REM (rapid eye movement) পর্যায়ে আমরা বেশি স্বপ্ন দেখি কারণ তখন আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি সচল থাকে। "দেজা রেভে" হল আপনি যা আগে কখনো স্বপ্ন দেখেছেন তা পুনরায় বাস্তবে দেখা। এর মানে, আপনি বর্তমানে যা চোখের সামনে দেখছেন তা একটি স্মৃতি এবং আপনি আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটার অনুরূপ কিছু বাস্তুবে দেখাকে দেজা রেভে বলে। অনেকেই মনে করেন যে দেজা রেভে হলো দেজা ভ্যূ এর বিপরীত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেজা রেভে হলো লুসিড ড্রিমিং এর বিপরীত এবং দেজা ভ্যূ এর অনুরূপ। ২০১৮ সালে ব্রেইন স্টিমুলেশন গবেষকরা বলেন যে দেজা রেভে সাধারণত আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা না বুঝার জন্য হতে পারে। ফরাসি দলটি দেজা রেভে এর উপর স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য আরো পরীক্ষানিরীক্ষা করতে থাকেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তারা দেখতে পান যে ১৯৫৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেজা রেভে হওয়া সবাই আংশিকভাবে মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলো। সাধারণত মৃগী রোগীদের চিকিৎসায় ইলেকট্রিক ব্র...

হিন্দু বিরোধী, বৈষম্যমূলক OBC আইন

২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসে। আর তারপরই রাজ্যের তথাকথিত পিছিয়ে পড়া (?) মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কল্পতরু হয়ে ওঠেন মমতা ব্যানার্জি। মুসলিমদের জন্য নানা রকম সুযোগ সুবিধা দিতে থাকেন। আর সেই সময় চুপিসারে ২০১২ সালে পাস হয়ে যায় একটি আইন- “ The West Bengal Backward Classes (Other than Scheduled Castes and Scheduled Tribes) (Reservation of Vacancies in Services and Posts) Act, 2012,”  🔴কি ছিল সেই আইনে? আইন অনুযায়ী OBC ( Other Backward Classes ) কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়; OBC-A এবং OBC-B । আর এইভাবে রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ঢালাও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ দিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই সংরক্ষণ দেওয়া হয় পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের কোটার ভাগ কেটে। এখানে উল্লেখযোগ্য, OBC-তে হিন্দুরা যে সংরক্ষণের সুবিধা লাভ করতেন, তা পিছিয়ে পড়ার মাপকাঠিতে। তাছাড়া, সংরক্ষণ তালিকায় তাদের জাতির সঙ্গে হিন্দু কথা লেখা থাকতো না। কিন্তু OBC-A এবং OBC-B ক্যাটাগরিতে  যাদের পিছিয়ে পড়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তাদের জাতির পাশে পরিষ্কার ‛মুসলিম’ কথা...